×

জাতীয়

রাজাকারের তালিকার অপেক্ষায় অর্ধ শতক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৩৩ এএম

রাজাকারের তালিকার অপেক্ষায় অর্ধ শতক

ছবি: সংগৃহীত

রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে গত ২৯ আগস্ট। ওই আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য ছিল বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে অথবা একক, যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ, সক্রিয় বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হবে।

এর আগে গত এপ্রিলে রাজাকারের তালিকা তৈরির জন্য তিন সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে চারটি বৈঠকও করেছে কমিটি। তবে বর্তমান মেয়াদেই রাজাকারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। এ ব্যাপারে মুক্তযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কমিটির সভা হচ্ছে। যাতে কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়, সেজন্য সচেতনভাবে তালিকা তৈরির কাজটি করতে হবে।

রাজাকারের তালিকা তৈরির জন্য গত এপ্রিলে গঠিত তিন সদস্যের একটি উপকমিটির সভাপতি করা হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খানকে। উপকমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন- মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। উপকমিটিকে রাজাকারের একটি নির্ভুল তালিকা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। জেলায় জেলায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে রাজাকারের তালিকা করে তা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) পাঠানোর কথা উপকমিটির। জানা গেছে, কী প্রক্রিয়ায় রাজাকার যাচাইবাছাই করা হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। রাজাকারের তালিকা তৈরির আগে বিধিমালাও করা হয়নি।

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছাইয়ে লম্বা সময় নিয়ে কাজ করেছি। এ কারণে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেছে। এখন রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করব। খুব কম সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি। নীতিমালার খসড়াও প্রায় তৈরি হয়ে গেছে।

তালিকা তৈরিতেই পেরিয়ে গেছে অর্ধ শতক : পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তার জন্য একাত্তরের মে মাসে খুলনায় খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান মো. ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করা হয়। শুরুতে ১০টি জেলায় ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতারা নেতৃত্ব পান। প্রথমে রাজাকার বাহিনী ছিল এলাকার শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করে আনসার বাহিনীকে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৭ সেপ্টেম্বর জারিকৃত অধ্যাদেশে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের সেনাবাহিনীর সদস্যরূপে স্বীকৃতি দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল ১৫ দিন। ১৪ জুলাই কুষ্টিয়ায় এই বাহিনীর প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। ২৭ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর কোম্পানি কমান্ডারদের প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং শেষে সাভারে বিদায়ী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ করেন জেনারেল এ কে নিয়াজি। পরে এই বাহিনীকে একটি স্বতন্ত্র অধিদপ্তরের মর্যাদা দেয়া হয়।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংসের গবেষণা অনুযায়ী, রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫০ হাজারের মতো। জেনারেল নিয়াজি তার বইতে এই সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতার পর রাজাকারদের বিচারে ৩৭ হাজার জনের একটি তালিকা করা হয়। পাকিস্তানপন্থি পত্রিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অভিহিত করা হতো ভারতীয় চর, দুষ্কৃতকারী হিসেবে। ‘রাজাকাররা ৭০ জন দুষ্কৃতকারী হত্যা করেছে’, ‘ভারতীয় চরকে নির্মূল করেছে’- এমন শিরোনামে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে বলা হয়েছে, তাদের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায় গ্রামে গঞ্জে অত্যাচার, নির্যাতন চালানো এবং সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী পথপ্রদর্শক হিসেবে ভূমিকা পালন করা।

গবেষকদের মতে, নিয়াজির বইয়ে ৫০ হাজার লোককে রিক্রুট করার কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্যদিকে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২ (দালাল আইন)’-এ ক্ষমা পায়নি ১১ হাজার রাজাকার। ওই নামের তালিকা নিশ্চয়ই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখনো রয়েছে। সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকার কথা। ওই নামগুলোর সঙ্গে কিছু নাম সংযোজন করা হলেই হবে।

অন্যদিকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা প্রকাশের পর দেশজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক। কারণ, রাজাকারের তালিকায় গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার নামও উঠে আসে। শহীদ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার নামও তালিকায় পাওয়া যায়। এ নিয়ে সংসদে তোপের মুখে পড়েন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। পরে সেই তালিকা স্থগিত করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করার চেয়েও রাজাকারের তালিকা করা সহজ বলে মন্তব্য করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা। তাদের মত, বিজয়ের পরপরই বঙ্গবন্ধু সরকার দালাল আইনে বিচার শুরু করলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বেকসুর খালাস দেয়া হয় ১১ হাজার যুদ্ধবন্দিকে। বঙ্গবন্ধুর সময় করা রাজাকারের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। সেখানে শুধু কিছু নাম যোগ করেই তালিকা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের সহযোগিতা প্রয়োজন।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিংস কমিটির আহ্বায়ক ডা. এম এ হাসান বলেন, রাজাকারের তালিকা বেশি জরুরি। প্রতিটি এলাকায় রাজাকারদের নাম টানিয়ে রাখা প্রয়োজন- যেন মানুষ জানতে পারে, ওই এলাকায় কারা কারা স্বাধীনতাযুদ্ধে মীরজাফরের ভূমিকায় ছিল। ইতিহাসের স্বার্থেই এটি প্রয়োজন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App