×

জাতীয়

পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৫ এএম

পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ

ফাইল ছবি

আইনের দুর্বলতায় নেই সুফল

পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি এবং প্রকাশ্যে এ কাজের জন্য দেশে জরিমানার বিধান আছে, যা অনেকেরই জানা। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আইনে পাবলিক প্লেস হিসেবে যেসব স্থানকে চিহ্নিত করে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানেই চলছে ধূমপান। যে কারণে অধূমপায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে নারী-শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীরা পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে বছরে ১২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয়। তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা না থাকলেও এর ধোঁয়ায় রয়েছে ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ। যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান। গেøাবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে-২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ, ২৪ শতাংশ গণপরিবহনে, ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ রেস্তোরাঁয় এবং ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ চা-কফির স্টলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাড়িতে ৩৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। ৬১ হাজার শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে। ‘সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন : আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শিরোনামে ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া ৯৫ শতাংশ শিশুর দেহে উচ্চমাত্রার নিকোটিন। যার মূল কারণ পরোক্ষ ধূমপান। এই গবেষণা দলের সদস্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক। তিনি ভোরের কাগজকে জানান, এই গবেষণারই অংশ হিসেবে ২য় পর্যায়ের আরেকটি গবেষণার তথ্য সংগ্রহের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। ৩৪টি স্কুলের ১ হাজার ৩৮৩ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণের কাজ চলছে এবং খুব শিগগিরই এই গবেষণার ফল প্রকাশ করা হবে।

পাবলিক প্লেসে ধূমপান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রকাশ্যে ধূমপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও, অনেকেই ‘পাবলিক প্লেস’ বিষয়টি ঠিক বোঝেন না। আবার অনেকে সচেতনও নন। বাসায় বসে ধূমপান করলে বাসায় অন্য যারা থাকেন, তাদের শরীরেও নিকোটিন প্রবেশ করে। এমনকি আলাদা রুমে ধূমপান করলেও ধোঁয়া অন্য রুমে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি জানালার পর্দা, সোফার কাভার, কাপড়-চোপড়ে নিকোটিন লেগে যায়। এর বাইরে রাস্তায়, বাসে, দোকানে, হোটেলে অনেকেই ধূমপান করেন। সেখান থেকেও শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। এমনকি বাইরে থেকে ধূমপান করে হাত-মুখ না ধুয়ে শিশুদের সংস্পর্শে গেলেও শিশুরা নিকোটিনের শিকার হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার সুযোগ থাকায় পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তবে সম্প্রতি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন (২০১৩ সালে সংশোাধন) খসড়া সংশোধনীতে যেসব প্রস্তাব অন্তর্ভুুক্ত করা হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে- সব পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার বিধান বিলুপ্ত করা। ইতোমধ্যে কানাডা, স্পেন, নেপালসহ বিশ্বের ৬৩টি দেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করে আইন রয়েছে।

পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞা

আইনে পাবলিক প্লেস বলতে যেসব স্থানকে বোঝানো হয়েছে তা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে রয়েছে অস্পষ্টতা। আইনে পাবলিক প্লেস বলতে বোঝানো হয়েছে- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণি ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোনো বা সকল স্থান। একই সঙ্গে পাবলিক পরিবহনের বিষয়ে বলা হয়েছে, পাবলিক পরিবহন বলতে বোঝানো হয়েছে মোটর গাড়ি, বাস, রেলগাড়ি, ট্রাম, জাহাজ, লঞ্চ, যান্ত্রিক সব ধরনের জন-যানবাহন, উড়োজাহাজ এবং সরকার কর্তৃক, সরকারি গ্যাজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্দিষ্টকৃত বা ঘোষিত অন্য যে কোনো যান। খসড়া আইনে ১০ স্থানে ধূমপান এলাকা নির্দিষ্ট করা যাবে না : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল এবং প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তর, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ এককক্ষবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশুপার্ক, খেলাধূলা ও অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত আচ্ছাদিত স্থান এবং এক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহন।

জরিমানার বিধান এবং তা আদায়ের দায়িত্ব যাদের

জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেখানে প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০ টাকা। পরে ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধূমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩শ টাকা করা হয়। এই জরিমানা যারা আদায় করতে পারবেন তারা হলেন- জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সব প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা; সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা; রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা; সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিচে নয় এমন পুলিশ কর্মকর্তা; মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার নিচে নয় এমন কর্মকর্তা; উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনে কর্মরত স্যানিটারি ইন্সপেক্টর; অগ্নি নির্বাপণ বা বেসামরিক প্রতিরক্ষা অধিদপ্তরে কর্মরত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা এবং কারখানা পরিদর্শক।

এ প্রসঙ্গে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস বাংলাদেশের লিড পলিসি এডভাইজার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যিনি ধূমপান করেন না তার অধিকার আছে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য। অথচ পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যাই বেশি। যেহেতু ধূমপানের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেজন্য সব ধরনের পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা উচিত।

গবেষণা ও এডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান’র (প্রজ্ঞা) নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের মনে করেন ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে কয়েকটি দুর্বল দিক আছে। আইনের সংশোধনী খসড়ায় সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে।

তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া মামলা করার বিধান নেই। যা আইনের দুর্বল দিক। সংশোধিত আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার লিখিত ছাড়াই মামলা করার বিধানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আইনে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞায় যেসব স্থানকে ধূমপানমুক্ত এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে আর কোনোভাবেই ধমূপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখা যাবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App