×

জাতীয়

কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয় তামাক কোম্পানি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৪৭ এএম

কোটি টাকা কর ফাঁকি দেয় তামাক কোম্পানি

ফাইল ছবি

সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যে শুভঙ্করের ফাঁকি বাজেটের আগে কমিয়ে দেয়া হয় সরবরাহ বাজেটপরবর্তী সময়ে নতুন প্যাকেট তৈরিতে গড়িমসি

দেশে ব্যবসারত সবচেয়ে বড় তামাক কোম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি এবং ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানি অভিনব কৌশলে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। নতুন মোড়ক তৈরি করতে সময়ক্ষেপণ এবং সর্বোচ্চ দাম না লেখার কারণে প্রতিনিয়ত ঠকছেন ভোক্তারা। এতে ভোক্তার সঙ্গে সরকারও প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সাধারণত জাতীয় বাজেট জুনে হয়ে থাকে। বাজেটের আগের মাস থেকে বাজারে সরবরাহ কমাতে থাকে তামাক কোম্পানিগুলো। মূলত তামাক কোম্পানির ডিস্টিবিউটর ও ডিলারদের অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ তৈরি করে দিতে এমন কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আর বাজেটপরবর্তী সময়ে এনবিআরের নিয়ম না মেনে প্যাকেট তৈরিতে সময়ক্ষেপণ করে বেশি দামে বিক্রি করা হয় সিগারেট। এতে একদিকে যেমন ভোক্তা ঠকেন; অন্যদিকে ঠকে সরকারও। কারণ এই দামের কোনো প্রমাণ নেই। যার কারণে সরকার এই অর্থের থেকে কোনো ধরনের রাজস্ব পায় না। আর কোম্পানিগুলোর এই অভিনব রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ)। তামাক কোম্পানির এমন অপকৌশল বন্ধে এনবিআরের কাছে এসআরও সংশোধনের জন্য চিঠিও দিয়েছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বর্তমানে নিম্নস্তরে সিগারেটে (১০ শলাকা) ৫৭ টাকা, মধ্যমস্তরে ৬৫ টাকা, উচ্চস্তরে ১১১ টাকা ও অতি উচ্চস্তরে ৬৫ টাকা সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। সঙ্গে রয়েছে ১৫ টাকা ভ্যাট ও এক শতাংশ হারে সারচার্জ। সে হিসাবে প্রতিদিন নিম্নস্তরে বাড়তি বিক্রি করা সিগারেটে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ১২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যমস্তরে হারাচ্ছে প্রায় দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর চার স্তরের সিগারেট থেকে মাসে প্রায় ৪১০ কোটি ৪০ লাখ এবং বছরে প্রায় ৪ হাজার ৯৯৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া সিগারেটের প্যাকেটে খুচরা মূল্যের আগে ‘সর্বোচ্চ’ শব্দ লেখা নেই। আর তাতেই প্রতিদিন সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত চলে যাচ্ছে- যা মাসে প্রায় ৬০০ কোটি আর বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, এনবিআরের এক কর্মকর্তা ইচ্ছেকৃতভাবে বিএটিকে এই সুবিধা দিয়েছেন। সর্বশেষ এলটিইউ এনবিআরকে সিগারেটসংক্রান্ত এসআরও সংশোধন করে বিক্রয় মূল্য বা খুচরা

মূল্য শব্দগুলোর পরিবর্তে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করার অনুরোধ জানিয়েছে।

সিগারেট বিক্রিতে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকোর (বিএটি) মুখপাত্র শেখ শাবাব ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা সরাসরি সিগারেট বিক্রি করি না। তাই আমাদের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া তারা উৎপাদন পর্যায়েই সরকারকে অগ্রিম রাজস্ব পরিশোধ করেন বলেও জানান এই কর্মকর্তা। তবে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএটির এই কর্মকর্তা বলেন, প্রজ্ঞাপন এনবিআর জারি করেছে। এই বিষয়টি তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে আমরা আইন মেনে ব্যবসা করি, দাবি এই কর্মকর্তার।

অভিযোগ উঠেছে, মূসক আইন ও বিধিতে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা থাকলেও সিগারেট কোম্পানিগুলো প্রভাব খাটিয়ে এসআরওতে বিক্রয় মূল্য বা খুচরা মূল্য লিখিয়ে নিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিগারেট কোম্পানিগুলো প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ শব্দ লিখছে না। এলটিইউতে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান তিনটি বিদায়ী অর্থবছর প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব দিয়েছে। একইসঙ্গে প্রায় ৭২০ কোটি মূল্যের তামাক পাতা ও সিগারেট রপ্তানি করেছে। ভ্যাটে আহরিত রাজস্বের প্রায় ৩০ শতাংশ সিগারেট খাত থেকে আসে।

এনবিআর সূত্র জানায়, খোলাবাজারে অতি উচ্চস্তরের প্রতি শলাকা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি শলাকা সিগারেটের বাজার দাম ও সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৮০ পয়সা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া উচ্চস্তরের প্রতি শলাকায় ৯০ পয়সা, মধ্যমস্তরে ৫০ পয়সা ও নিম্নস্তরে ১ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছর (৩৬৫ দিন হিসাবে) মোট ৭ হাজার ১৮৭ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে প্রিমিয়াম বা উচ্চস্তরে ৫৯৩ কোটি, উচ্চস্তরে ৫৬৭ কোটি, মধ্যমস্তরে ৬০৩ কোটি ও নিম্নস্তরে ৫ হাজার ৪২৪ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী, একদিনে সিগারেট বিক্রি হয়েছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ শলাকা।

২০২০-২১ অর্থবছরের সিগারেট বিক্রির সঙ্গে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সিগারেট বিক্রির হিসাবের তুলনা করে দেখা যায়, বর্তমানে বাজারে প্রিমিয়াম স্তরে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতি শলাকা ১ টাকা ৮০ পয়সা বা ৮০ পয়সা বেশি বিক্রি হচ্ছে। একদিনে প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেট বিক্রি হচ্ছে এক কোটি ৬২ লাখ ৪৬ হাজার ৫৭৫ শলাকা এবং ৩০ দিনে বিক্রি হচ্ছে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৬০ শলাকা। ৮০ পয়সা হিসেবে বাড়তি প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ টাকা আর ৩০ দিনে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা সিগারেট কোম্পানি ভোক্তা থেকে বেশি নিচ্ছে। এক টাকা ৮০ পয়সা হিসেবে একদিনে প্রায় ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ও ৩০ দিনে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে উচ্চস্তরে একদিনে এক কোটি ৫৫ লাখ ৩৪ হাজার ২৪৬ শলাকা ও ৩০ দিনে ৪৬ কোটি ৬০ লাখ ২৭ হাজার ৩৮০ শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়। ৯০ পয়সা হিসাবে প্রতিদিন উচ্চস্তরে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ৩০ দিনে প্রায় ৪২ কোটি টাকা সিগারেট কোম্পানি বেশি নিচ্ছে। মধ্যমস্তরে একদিনে এক কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার ৫৪৭ শলাকা ও ৩০ দিনে ৪৯ কোটি ৫৬ লাখ ১৬ হাজার ৪১০ শলাকা সিগারেট বিক্রি হয়। ৫০ পয়সা হিসাবে প্রতিদিন মধ্যমস্তরে প্রায় ৮২ লাখ টাকা ও ৩০ দিনে প্রায় ২৫ কোটি টাকা বাড়তি নেয়া হচ্ছে। নিম্নস্তরে প্রতিদিন সিগারেট বিক্রি হয় ১৪ কোটি ৮৬ লাখ ২ হাজার ৭৩৯ শলাকা ও ৩০ দিনে ৪৪৫ কোটি ৮০ লাখ ৮২ হাজার ১৭০ শলাকা সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। নিম্নস্তরে এক টাকা হিসাবে একদিনে প্রায় ১৫ কোটি ও ৩০ দিনে প্রায় ৪৪৬ কোটি টাকা বাড়তি নিচ্ছে সিগারেট কোম্পানি। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ২০ কোটি টাকা ও মাসে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার বিক্রি করা সিগারেটের ওপর রাজস্ব পায় না সরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App