×

জাতীয়

কর্ণফুলী তীরের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

কর্ণফুলী তীরের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে

ছবি: ভোরের কাগজ

দখল-দূষণে বিপর্যস্ত চট্টগ্রামের ‘হৃদপিণ্ড’ খ্যাত কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত কর্ণফুলীর দুই তীরে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্তির হুমকির মুখে। দূষণ ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আরো ৬১ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে যাবে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপেইনিয়ন’ (ইকো) পরিচালিত এক গবেষণায় উদ্ভিদের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার জন্য ৫৩টি শিল্প-কারখানাসহ ৮৯টি উৎসের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদী দূষণকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা আট মাস মাঠ পর্যায়ে জরিপ চালিয়ে উদ্ভিদ ও কর্ণফুলী নদী দূষণের উৎস শনাক্তের পাশাপাশি কর্ণফুলীর প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এ গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল নেতৃত্ব দিয়েছেন। একই বিভাগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন শিক্ষার্থী গবেষণা কর্মে অংশ নেন।

গতকাল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে গবেষক ড. ওমর ফারুক রাসেল বলেন, ‘কাফকো কারখানা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কাপ্তাই পর্যন্ত নদীর দুই পাড়ে কত প্রজাতির উদ্ভিদ আছে এবং এদের মধ্যে কতগুলো কী কারণে বিপন্ন ও বিলুপ্তির পথে যাচ্ছে সেটা আমরা গবেষণা করে বের করার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি উদ্ভিদগুলোকে সংরক্ষণের তাগিদ দেয়াও ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। গবেষণায় আমরা কণফুলী নদীর দু’পাশে মোট ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করেছি। এর মধ্যে ৮১টি বিপন্ন প্রজাতি ও ৬৩টি ভবিষ্যতে বিপন্ন হতে পারে এমন প্রজাতি শনাক্ত হয়েছে। অন্য যেসব উদ্ভিদ প্রজাতি আছে সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু কোনো কোনো এলাকায় বিলুপ্ত, আবার কোনো কোনো এলাকায় মোটামুটি পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, কর্ণফুুলী নদীতীরের উদ্ভিদগুলো অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই করছে।’

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- শনাক্ত হওয়া ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে ৩৭৩ টি গণভুক্ত এবং ১১৩টি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ১৪৪ প্রজাতির, গুল্ম ৬৯ প্রজাতির, লতা ৫৮ প্রজাতির, বীরুৎ ২৪৪ প্রজাতির এবং পরজীবি-পরগাছা ১৩ প্রজাতির। শনাক্ত প্রজাতির মধ্যে ১টি নগ্নবীজি, ৯টি মসগোত্রীয় এবং ২৭টি ফার্ণ প্রজাতির। একবীজপত্রী উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে ১১২ প্রজাতির আর দ্বিবীজপত্রী ৩৭৯ প্রজাতির। দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের মধ্যে ফ্যাবেসি গোত্রভুক্ত গাছ সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হয়েছে। দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের মধ্যে বট এবং কড়ই গাছ বেশি। একবীজপত্রী উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত হওয়া ঘাস জাতীয় নিম, দূর্বাঘাস, হাড়গোজা, হিজল, কেরেঞ্জা, লজ্জাবতী উদ্ভিদের প্রাধান্য লক্ষ্য করেছেন গবেষকরা।

গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শনাক্ত ৩৫৫ প্রজাতির মধ্যে কালমেঘ, হিজল, বেগুনি হুরহুরিয়া, হাড়গোজা, ছাতিম, আকন্দ, তুফানি লতা, হাতিশুঁড়, সোনালু, স্বর্ণলতা জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে কর্ণফুলী তীরের বিভিন্ন এলাকায়। বিলুপ্তির পথে থাকা ৮১ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কালমেঘ , গংগাতারা, কাঁটা বিশাল্লা, উপকালিস, বেগুনি আমড়া, ছোট ছাতিম, ফুলিবেত, ইছারমূল, বন শিমুল, হলুদ কৃষ্ণচূড়া । বিপন্নের আশঙ্কায় থাকা ৬৩ প্রজাতির উদ্ভিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কুজ শ্যামলতা চীনালতা খনা, অশোক, বরুন, ফুল ঝুমুরি, গোল তকমা ইত্যাদি।

সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুঘাট সেতুর পর হালদা নদীর মোহনা পর্যন্ত। সেখানে মোট ১২০ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। নদীর মাঝখানে বাকলিয়ার চরে ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত হয়েছে। কর্ণফুলী নদী দূষণের জন্য ৮৯টি উৎস শনাক্ত করেছেন গবেষকরা। এসব উৎসের মধ্যে ৫৩টি শিল্প কারখানা, ১৪টি নৌযান মেরামতের স্থান, কাঁচাবাজার, নালা, খামার, শুঁটকিপল্লী আছে, যার অধিকাংশই সাগরের মোহনা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত এলাকায়। পানি ও বায়ু দূষণের জন্য দায়ী ৭৫টি করে উৎস, মাটি দূষণের জন্য ৪০টি, শব্দ দূষণের জন্য ৪টি, তাপীয় দূষণের জন্য ১৮টি, ধূলার দূষণ ৫টি, ভারী ধাতুর দূষণ ২৯টি, প্লাস্টিকের ১৫টি এবং নদীতীরে ভূমিক্ষয়ের ১০টি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে গবেষণায় দূষণের জন্য ৩০টি কারণ শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্গত বর্জ্য, নগর বর্জ্য বিভিন্ন নালা-ড্রেন দিয়ে সরাসরি নদীতে মিশে যাওয়া, নদীর তীরে পোড়া তেল বিক্রি, কাগজ কারখানা থেকে নিঃসৃত বর্জ্য, জাহাজ মেরামত কারখানা থেকে পুরনো রঙ-মরিচা পানিতে মিশে যাওয়া, শুঁটকিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সবিক্রন-৪২৫ পানিতে ফেলা, অপচনশীল ভাসমান প্লাস্টিক, পলিথিন, মৃত পশু-পাখি সরাসরি নদীতে ফেলা এবং বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার।

এছাড়া আছে- নৌকা ও জাহাজ নদীতে পরিষ্কার করা, কৃষিজমি থেকে সার ও কীটনাশক নদীর পানিতে মিশে যাওয়া, সিমেন্ট কারখানা ও নির্মাণাধীন এলাকা থেকে বালি ও অন্যান্য উপাদান পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া এবং নদীর তীরে ইটভাটা ও অবৈধ স্থাপনা। জরিপের তথ্যে বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, কর্ণফুলী নদীতে ৮৫টি মার্চেন্ট জাহাজ, ৪০৫টি কোস্টাল জাহাজ, ২৬৪টি মাছ ধরার ট্রলার, ৯টি টাগবোটসহ অনেক বিদেশি জাহাজ, ট্রলার, সাম্পান, ছোট নৌকা চলাচল করে। এসব নৌযানের ময়লা, পোড়া তেল সরাসরি নদীতে ফেলা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী খন্দকার রাজিউর রহমান বলেন, কালুরঘাট সেতু থেকে কর্ণফুলী নদীর উজানের দিকে গেলে কেওড়া গাছসহ নানা প্রজাতি উদ্ভিদের দেখা মেলে। এ অঞ্চলে কিছুটা সবুজ এখনো আছে। কিন্তু ভাটির দিকে খুব খারাপ অবস্থা।

গবেষক ড. ওমর ফারুক রাসেল বলেন, নদীর দুই তীরে ৭টি শিল্প কারখানা থেকে নদীতে সরাসরি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। বর্জ্যের নমুনা সংগ্রহ করে আমরা ল্যাবে বিশ্লেষণ করি। এতে মানবদেহ ও প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। উচ্চমাত্রার ক্ষারকীয় দ্রবন, দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ পেয়েছি। আরো মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক যেসব দ্রব্য আছে সেগুলো শনাক্ত করতে অধিকতর গবেষণার প্রয়োজন। নদীতে বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণের ফলে দৈনন্দিন কাজে নদীর উপর নির্ভরশীল মানুষগুলোর চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার হতে পারে। গবেষক দলের সদস্য চবি’র উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সজীব রুদ্র বলেন, আমাদের গবেষণায় বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে কালুঘাট সেতুর পর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখা গেছে। এই এলাকায় নদী দখল, বর্জ্য পদার্থ ও শহরের ড্রেনের দূষিত পানি মিশ্রণ দেখা গেছে। এর ফলে এই এলাকায় উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অনেক কম এবং যেগুলো এখনো টিকে আছে, যদি দূষণ-দখল বন্ধ না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই প্রজাতিগুলোও হারিয়ে যাবে।’

উদ্ভিদ সংরক্ষণে ইকোর সুপারিশ : ইকো’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য এস এম আবু ইউসুফ সোহেল বলেন, কর্ণফুলীর দূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। নদীভাঙন রোধে কর্ণফুলীর তীরে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে বেশি দূষিত এলাকায় নদীর দুই তীরে ব্যাপকভাবে গাছ লাগাতে হবে বলে আমরা মনে করি। এখনই যদি উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে শনাক্ত হওয়া ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ আর সংরক্ষণ করা যাবে না। কর্ণফুলী প্রাণ-প্রকৃতিহীন মৃত নদীতে পরিণত হবে।

গবেষক ওমর ফারুক রাসেল নদী দূষণ বন্ধে পলিথিনের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করে জরুরি প্রয়োজনে পরিবেশবান্ধব বায়ো-ডিগ্রেডেবল পলিথিন ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ইকো’র সভাপতি সরওয়ার আলম চৌধুরী মণি বলেন, আমরা মনে করি, প্রশাসন কঠোর হলে এবং জনগণ সচেতন হলে চট্টগ্রামের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা পাবে। ইকো’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহেদ মুরাদ সাকু বলেন, আমরা কর্ণফুলী নদীতীরের উদ্ভিদবৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করছি। ভবিষ্যতে পরিবেশ রক্ষায় ইকো এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App