×

জাতীয়

যুগপৎ আন্দোলনের ছক চূড়ান্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৭ এএম

নভেম্বরে রোডম্যাপ ঘোষণা করে জানুয়ারিতে সর্বাত্মক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে বিএনপি

ছোট দলের বড় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শিগগির যুগপৎ আন্দোলন শুরু করতে চায় দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। বৈশ্বিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়ে আন্দোলনের রোডম্যাপও প্রস্তুত করছে দলটি। যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগসহ ১০-১১টি রাজনৈতিক দাবি চূড়ান্ত করা হয়েছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এ বিষয়ে ঘোষণা দিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই সমমনা দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একযোগে মাঠে নামবে বিএনপি। দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র এমন তথ্য নিশ্চিত করেছে।

যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে ডান-বাম-ইসলামী ২২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে বিএনপি। ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দলসহ নবগঠিত গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত সাতটি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে তারা।

সূত্র জানায়, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তার অধিকাংশই বিএনপির রোডম্যাপে স্থান পেয়েছে। বিএনপির চিন্তার সঙ্গে সমমনা ওইসব দলের পরিকল্পনাও প্রায় একই হওয়ায় রোডম্যাপ নিয়ে মতপার্থক্য হবে না। গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া সমমনা দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপেও বিএনপির তৈরি করা খসড়া রোডম্যাপ ধরেই আলোচনা হচ্ছে। চলতি মাসেই দ্বিতীয় দফার সংলাপ শেষ করা হবে। সংলাপ শেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি যৌথভাবে ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে আগে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যমতে আসতে চায় বিএনপি। এ লক্ষ্যে প্রথম দফা সংলাপে দলগুলোর সঙ্গে আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক আলাপ-আলোচনা শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ‘ফাইনাল রিহার্সেল’ চলছে। এরই মধ্যে দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে ১০-১১টি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের রোডম্যাপ প্রস্তুত করা হয়েছে। এরমধ্যে অগ্রাধিকার হচ্ছে- দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও সুচিকিৎসা এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা। দ্বিতীয় দফা আলোচনার পর এই রোডম্যাপ চূড়ান্ত করে জাতির সামনে তুলে ধরবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

সংশ্লিষ্ট দলগুলোর একাধিক নেতা জানান, বিএনপির পক্ষ থেকে ‘জাতীয় ঐক্যের দাবি ও লক্ষ্য’- এ শিরোনামে যুগপৎ আন্দোলনের রোডম্যাপের খসড়া এক মাস আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে তাদের কাছে পৌঁছেছে। খসড়ায় কোনো সংযোজন-বিযোজন থাকলে তা নিয়ে দ্বিতীয় দফা সংলাপে তুলে ধরার জন্য বলা হয়েছে। নেতারা জানান, এসব রূপরেখায় এখন পর্যন্ত ৮-৯টি ইস্যু চূড়ান্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে আরো ২-৩টি দাবি সমন্বিত করে রোডম্যাপটি ১০ বা ১১ দফায় চূড়ান্ত হবে। আন্দোলনের রূপরেখায় সরকারের পদত্যাগ দাবি করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।

জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, জনগণের দাবি আদায়ে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তুলতে বেশ কিছুদিন ধরে সংলাপ চলছে। সংলাপে সব দলই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া ও যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দ্রুতই জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নির্ধারিত হবে।

আন্দোলনের রোডম্যাপে যা থাকছে: কমপক্ষে ১০টি বিষয়কে সামনে রেখে ঐক্যের রোডম্যাপে থাকছে- বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ বা অন্তরর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ইভিএম বাতিল, আরপিও সংশোধন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকটের সমাধান, শেয়ার বাজার ও ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ করা, রাজনৈতিক বন্দিদের মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি, ডিজিটাল আইনসহ ১৯৭৪ সালের কিছু আইন বাতিল, ১৫ বছরে সংঘটিত গুম-খুনের বিচারের বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জনসম্পৃক্ত প্রতিটি সেক্টর ধরে পয়েন্ট আকারে আলাদা প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে।

আগে যুগপতের সূচনা পরে রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরিকল্পনা: লক্ষ্য অর্জনে দুটি পর্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে বিএনপি। প্রথমত. বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য ডান-বাম-ইসলামী সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। দ্বিতীয়ত. নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী হলে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের পরিকল্পনা। এ বিষয়ে বিএনপির রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করছেন এমন নেতাদের বক্তব্য- নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনে সক্ষম হলে বিএনপি ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে। আর এই সরকার কী কী রাজনৈতিক অঙ্গীকার করবে, তা ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এক্ষেত্রে বিস্তারিত রূপরেখা প্রস্তুতের কাজ চলছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে।

জানতে চাইলে জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, আমরা বৃহত্তর ঐক্যে বিশ্বাস করি ও এটি সমর্থন করি। তিনি বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে আমরা একমত হয়েছি; তবে আন্দোলনের দিন-ক্ষণ এখনই প্রকাশ করবে না। তবে চমক আছে। রাজপথে দেখতে পাবেন। এখানে জয় ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।

খুচরা দলের বড় নেতারা কি পারবে!: যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে যেসব দলগুলো সংলাপ করছে তার বেশিরভাগই খুচরা। দলগুলো প্রধান নেতা রাজনীতিতে চেনা হলেও দলে সক্রিয় নেতাকর্মী নেই বললেই চলে। সারা বছর তাদের তেমন কোনো কর্মসূচি থাকে না। তবে ভোট এলেই এদের কদর বাড়ে। তাইতো এসব খুচরো দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে গিয়ে ভোটের মাঠে বিএনপি কতটা ফয়দা নিতে পারবে তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এমনকি শরীক দলের কেউ কেউ বিএনপির এমন উদ্যোগ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। তারা মনে করছেন, অনেক দল আছে যারা নামসর্বস্ব, জোটে কিংবা রাজনীতির মাঠে তাদের ভূমিকা রাখার কোনো সক্ষমতা নেই। তাছাড়া বেশিরভাগই ভঙ্গুর। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত।

বিএনপি জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা এলডিপি প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেন, বড় রাজনৈতিক দল ছাড়া বেশির ভাগ দলই নামসর্বস্ব। কোনো কোনোটা আছে স্বামী-স্ত্রীর দল। তাই এসব দলের সঙ্গে বসলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। সময় নষ্ট করা হবে। আপাতত এতটুকুই বলব। বরং জামায়াত একটি পুরনো রাজনৈতিক দল, ভোটের মাঠে তাদের এখনো আবেদন কম নয়। তাছাড়া এখনকার যারা জামায়াতে আছে, তাদের মধ্যে তো যুদ্ধাপরাধী নেই। তাহলে তাদের নিয়ে আপত্তি কেন!

এক মঞ্চে নেতৃত্ব দেয়ার মতো নেতার অভাব: বিগত নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা নির্বাচন করে তার নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। এ কারণে দেশি-বিদেশি নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে। ক্ষমতায় গেলে কে হবেন সরকার প্রধান- ভোটের আগে তা স্পষ্ট করতে না পারা ভুল ছিল বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। তাই এবারের বৃহৎ ঐক্যের প্রধান নেতা নির্বাচনের বিষয়ে বেশ সর্তক আলোচনা শুরু হয়েছে দলটির ভেতরে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা স্পষ্ট করার ব্যাপারে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং লন্ডনে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই চিন্তা করেছন।

বিষয়টি স্পষ্ট করে গতকাল সোমবার ২০ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সঙ্গে সংলাপ শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, সরকার হটানোর ‘যুগপৎ আন্দোলন’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই হবে। তিনি বলেন, আমাদের নেতৃত্ব বা নেতা আগেই ঘোষণা করেছি; খালেদা জিয়া আমাদের নেত্রী। তার অবর্তমানে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতা। তার এই ঘোষণার পর খোদ বিএনপিতে আলোচনা উঠেছে- ঐক্যের নেতারা তারেক রহমানকে যুগপৎ আন্দোলনের নেতা মানছেন না বলেই দলের মহাসচিব ফলাও করে খালেদা জিয়ার নাম ঘোষণা করেছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App