×

জাতীয়

নির্বিঘ্নে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

নির্বিঘ্নে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসব

বুধবার মর্ত্য থেকে কৈলাসে স্বামীগৃহে ফিরে যান মা দুর্গা। ছবি: ভোরের কাগজ

‘কৈলাসে মা ফিরলি রে তুই/ সকল কথা ফেলে রেখে/ মন ভরল কোথায় মা গো/ তোর ওই মুখ দেখে দেখে।’ এই কথামালার মধ্যেই ফুটে উঠেছে ভক্ত মনে দেবী দুর্গার জন্য আকুলতা। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গা সপরিবারে আবার ফিরে গেলেন স্বর্গলোকের কৈলাসে স্বামীর ঘরে। এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো শারদীয় দুর্গোৎসবের সব আয়োজন। পাঁচ দিনের আনন্দ-উল্লাসকে অতীত করে গতকাল বুধবার ভক্তরা চোখের জলে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়েছেন। কাতর কণ্ঠে বিশ্ব শান্তির প্রার্থনা করেছেন দেবীর কাছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, যেতে যেতে ভক্তদের মাঝে দেবী দিয়ে যান অভয় বার্তা। আর আসছে বছর আবার আসার প্রতিশ্রুতি। এদিকে সারাদেশে নির্বিঘ্নে শারদীয় দুর্গোৎসব সম্পন্ন হওয়ায় সরকার ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা।

সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় সপরিবারে দেবী দুর্গা এবার মর্ত্যলোকে (পৃথিবী) আসেন গজে (হাতি) চড়ে। শাস্ত্রমতে, গজ হচ্ছে জ্ঞান এবং সমৃদ্ধির প্রতীক এবং দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। তাই দেবীর আগমন বা গমন গজে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে। পূর্ণ হয় ভক্তের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্তলোকবাসী। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ। দেবী সপরিবারে স্বর্গালোকে বিদায় নেন নৌকায় চড়ে। যার ফল হচ্ছে বন্যা হওয়ার আশঙ্কা। যাওয়ার লক্ষণ শুভ না হলেও ভক্তের বিশ্বাস, দেবী মঙ্গলময়ী। তিনি জগতের মঙ্গলই করবেন। মহালয়ার দিন ‘কন্যারূপে’ ধরায় আসেন দেবী দুর্গা; বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। তার এই ‘আগমন ও প্রস্থানের’ মাঝে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত পাঁচ দিন চলে দুর্গোৎসব।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি যেমন কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী দুর্গা যে কদিন পিতৃগৃহে ছিলেন, ঢোলের বাদ্য সে কদিন ভক্তদের মনে ভক্তি আর আনন্দ মূর্ছনা দুই-ই জাগিয়েছে। গতকাল সকালে দশমীর বিহিত পূজা এবং দর্পণ বিসর্জনে শেষ হয় দেবীর শাস্ত্রীয় বিসর্জন। পাশাপাশি দেবী প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। এরপর পুষ্পাঞ্জলিও দেয়া হয়। এছাড়া আরাধনা আর সধবা নারীর সিঁদুর খেলার আচারে মুখরিত থাকে প্রতিটি মণ্ডপ। বিকাল পর্যন্ত চলে সিঁদুর খেলা আর আনন্দ, উৎসব। এ সময় ভক্ত মনে বেজেছিলো ‘বিদায় দেবার আগে মা তোর /গাল দুখানি ছুঁই /আসছে বছর এই শরতে/ আবার আসিছ তুই’- এমন সুর।

গতকাল দুপুরে পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য এই বিজয়া শোভাযাত্রা। বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনে অংশ নিতে দুপুর গড়িয়ে যেতেই ভক্তরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামণ্ডপ থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানের পূজামণ্ডপ থেকে আসা প্রতিমা নিয়ে ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায় রাস্তায়। প্রতিটি ট্রাকে দুর্গার পাশাপাশি ল²ী, সরস্বতী, কার্ত্তিক ও গণেশের প্রতিমাও ছিল। শোভাযাত্রাটি পলাশী মোড় থেকে শুরু হয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটে গিয়ে পৌঁছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল, এবার ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে পলাশী- কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে নবাবপুর রোড থেকে সদরঘাট হয়ে ওয়াইজঘাটে বুড়িগঙ্গা তীরে শেষ হবে শোভাযাত্রা।

ঢাকের শব্দে আর ধূপের গন্ধে মুখরিত হয়ে উঠে ওয়াইজঘাট এলাকা। শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ নেচে-গেয়ে শোভাযাত্রাকে আরো বর্ণিল করে তোলে। সেখান থেকে সম্মিলিত বাদ্যি-বাজনা, মন্ত্রোচ্চারণ ও পূজা-অর্চনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় শোভাযাত্রা। যাত্রাপথে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে পুলিশ সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখে। সড়কে পুলিশের ও নদীতে ছিল নৌপুলিশের টহল। ফায়ার সার্ভিস টিমও দায়িত্ব পালন করে। এ সময় বুড়িগঙ্গার দুই তীরে হাজারও ভক্ত ও দর্শনার্থী প্রতিমা বিসর্জন দেখতে ভিড় করেন। অনেকে প্রতিমা বিসর্জনের সময় নৌকায় করে নদীতে আনন্দ করে। এ উপলক্ষে গতকাল ওয়াইজঘাট এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।

বিকাল ৪টায় বুড়িগঙ্গার ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নানঘাটে পুরান ঢাকার শঙ্খনিধি মন্দিরের প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানো শুরু হয়। একে একে চলে প্রতিমা বিসর্জন। অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হলেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি রেখে দেয়া হয়। কিন্তু পূজার কাজে ব্যবহৃত দেবীর ফুল, বেলপাতা ও ঘট বিসর্জন দেয়া হয়। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ধ্যা আরতির পর মিশনের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে জল এনে (শান্তিজল) মঙ্গলঘটে নিয়ে তা আবার হৃদয়ে ধারণ করা হয়। আগামী বছর আবার এ শান্তিজল হৃদয় থেকে ঘটে, ঘট থেকে প্রতিমায় রেখে পূজা করা হবে। বিসর্জনের পর ভক্তরা শান্তিজল নেয় এবং মিষ্টিমুখ করেন।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে, সারাদেশে এ বছর ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগরে মণ্ডপের সংখ্যা ২৪১টি। এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপনের জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখে।

পাশাপাশি আয়োজকদের পক্ষ থেকেও মণ্ডপ পাহারায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয়। প্রতিটি মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর নির্দেশনাও ছিল সরকারের পক্ষ থেকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App