×

জাতীয়

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের বৈশ্বিক স্বীকৃতি কতদূর?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০১৮, ১০:৪৩ এএম

২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের বৈশ্বিক স্বীকৃতি কতদূর?
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। এইদিন বাংলার মাটিতে মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকাসহ সারা দেশে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর শুরু হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা। নয় মাসজুড়ে বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে যে নিধন অভিযান পরিচালিত হয়েছিল তার ভয়ঙ্করতা ও ব্যাপকতা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ বিশেষ ছিল না। পাকিস্তানিরা অনেকভাবে চেষ্টা করেছিল হত্যাযজ্ঞের বাস্তবতা আড়াল করে রাখতে, কিন্তু ক‚টনীতিক মহল, আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা গোষ্ঠী ও বিভিন্ন সূত্রে খবর পৌঁছেছিল বিশ্ববাসীর কাছে। আর তাই সামরিক আঘাতের শিকার বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবার জন্য দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল সংহতি আন্দোলন। বাংলাদেশে যা ঘটছে সেটা যে জেনোসাইড বা গণহত্যা, তা শনাক্ত করে ধিক্কার জানাবার মতো মানুষ তখন অনেক মিলেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি মেলেনি! বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যুদ্ধ’ হিসেবে দেখার তীব্র প্রবণতা রয়েছে কারো কারো মধ্যে। একাত্তরে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া এবং আড়াই লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনাকে খাটো করে দেখার চেষ্টা চলেছে। বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ের কথা বলা হলেও এ বিষয়ে উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, উদ্যোগহীনতার কারণে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সুযোগটি হাতছাড়াও হয়ে যেতে পারে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৯৭১ সালে ভয়াবহ গণহত্যা একদিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পাচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক বিদেশি গবেষকও একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্বের অন্তত সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও দেশের মধ্যে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি ও ডিপল ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকোরি, ইউনিভার্সিটি অব হংকং ও পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লজে গণহত্যার বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ প্রোগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ইন্দোনেশিয়াসহ মোট ১৪টি গণহত্যার বিষয়ে উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ‘আদার’ বা অন্য গণহত্যার তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। বলা হয়েছে, এ গণহত্যার বিষয়টি গবেষণার দাবি রাখে। কিন্তু নিজ দেশের উচ্চশিক্ষায়ও বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পায়নি, তেমনি এত বড় ঘটনার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মেলেনি। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইডে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ আছে। কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া- এই পাঁচটি উপাদানের কোনো একটি থাকলেই কোনো ঘটনা গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক মফিদুল হক বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশি করে আলোচনায় এসেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটি পাঠ্যবিষয় হিসেবে স্থান পেতে শুরু করেছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, কোনো জনগোষ্ঠীর আন্তরিক তৎপরতা থাকলে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় যে সম্ভব, তার প্রমাণ আর্মেনীয়রা। ১৯১৫ সালে অটোমান সা¤্রাজ্যের শেষ দিকে তুরস্কে ১৫ লাখ আর্মেনীয় গণহত্যার শিকার হয়। গত শতাব্দীর প্রথম গণহত্যা বলে এটি স্বীকৃত। এই গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আর্মেনীয়রা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছে। বছর বিশেক আগে থেকে ওই হত্যাকাণ্ড গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এ পর্যন্ত ফ্রান্স, রাশিয়াসহ ২০টি দেশ ওই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বছরের জুন মাসে তুরস্কের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও জার্মানির পার্লামেন্ট আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরও মনে করেন, বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য সরকারকে তৎপর হতে হবে এবং আর্মেনীয়দের মতো সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টের পর সবচেয়ে নৃশংস ও পরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সরকারি হিসেবে ২ লাখ, বেসরকারি হিসেবে ৫ লাখেরও অধিক নারীর উপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সর্বস্বহারা ১ কোটি মানুষ ভিটেমাটি ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায় ৩ কোটি মানুষকে দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ’৭১-এর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে। শাহরিয়ার কবির বলেন, ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তের শেষ অংশ কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে- যেখানে বলা হয়েছে ‘এ দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নেয়া হবে।’ এ বিভ্রান্তি লক্ষ্য করে আমরা গত বছর ১৪ মার্চ (২০১৭) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও শীর্ষ কমকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং লিখিত প্রস্তাবেও বলেছি- ২০১৫ সালের আগে সরকার উদ্যোগ নিলে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার সম্ভাবনা ছিল, যা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের পর সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য। গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান ও ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ ও তাদের তালিকা তৈরির কাজে ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা ও একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগের কার্যক্রমে তাদের পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, ভারত-রাশিয়া, চীন ও জাপান রোহিঙ্গাদের ওপরে গণহত্যা নিয়ে ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এমনকি রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করতে তাদের ভয়। তাদের কাছে মানুষ কোনো বিষয় নয়, তাদের চাই জমি। যেমনটা একাত্তরে টিক্কা খান বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বলেছিলেন, ‘আমার চাই জমি’। ‘১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে বলা হলেও এই সংখ্যা আরো বেশি। এ ছাড়া ধর্ষণের শিকার হন পাঁচ লাখ নারী’- এ তথ্য উল্লেখ করে মুনতাসীর মামুন বলেন, দেশের ইউনিয়ন-উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর, শহীদদের স্মৃতি ও নির্যাতনের স্মারকগুলো চিহ্নিত করে তা রক্ষার চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের আমলারা এসব কাজে আমাদের অসহযোগিতা করছেন, অনেক ক্ষেত্রে বাধা দিচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, ২৫ মার্চের আঘাতটি ছিল মানুষের জীবনের ন্যায্য অধিকারের প্রতি, মানব মর্যাদার প্রতি, স্বাধীন সত্ত্বাসংশিষ্ট চিরন্তন আকাক্সক্ষার প্রতি। দেশে দেশে ঘটে যাওয়া সভ্যতাবিনাশী, মর্যাদাবিধ্বংসী এমন নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্যই ২৫ মার্চের মতো দিনগুলোকে স্মরণীয় করে রাখা প্রয়োজন। এটি স্মরণ করতে হবে এই কারণে, যাতে এমন দিন আর কোথাও ফিরে না আসে। ২৫ মার্চের কৃষ্ণ রাতে জমাট হয় যে আকাক্সক্ষা তা স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। এটাকে সামনে এনে আলোকোজ্জ্বল করতে হবে জাতির আত্মপরিচয় ও মূল্যবোধ। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গবেষক আরো বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাঁচ হাজার বধ্যভূমির সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে এক হাজার বধ্যভূমি চিহ্নিত। আমরা গণহত্যা প্রমাণের জন্য ফরেনসিক এভিডেন্সও জোগাড় করেছি? আর আমরা বধ্যভূমি থেকে মাথার খুলি, শরীরের হাড়গোড়ও পেয়েছি। এখানে ১৯৭১ সালে যা হয়েছে তা তো গণহত্যা অবশ্যই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। উল্লেখ্য গত ১২ মার্চ ২০১৭ সালে একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য সংসদে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, একাত্তরের গণহত্যার ঘটনা যারা ভুলে যায়, তাদের এই দেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে যারা দহরম-মহরম করে, তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত। ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য ১৪৭ বিধিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাসদের সাংসদ শিরীন আখতার। তিনি প্রস্তাব করেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যাকে স্মরণ করে দিনটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। তাই এই প্রস্তাব সংসদে গ্রহণ করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App