×

জাতীয়

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন আকবর আলি খান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:৪৯ এএম

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন আকবর আলি খান

ড. আকবর আলি খান। ছবি: সংগৃহীত

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তাঁর বিদায়ে ‘জাতির মঙ্গলকামী একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রখরবুদ্ধি সম্পন্ন সৎ ব্যক্তিকে হারালাম’ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘নতুন প্রজন্ম যেন তাঁর পদচিহ্ন এবং চেতনাচিহ্ন অনুসরণ করতে উদ্দীপ্ত হয় এই কামনা করছি।’

শুক্রবার (৯ সেপ্টেম্বর) ফেসবুক স্ট্যাটাসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা লিখেছেন।

স্ট্যাটাসে তিনি আরও লিখেছেন, ‘ড. আকবর আলি খান একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, এটা নির্দ্বিধায় সবাই স্বীকার করেন। আমার কাছে তাঁর প্রতিভার চাইতেও বড় ছিলেন মানুষ আকবর আলি খান। তাঁর এই মাত্রার মধ্যে কোনো খাঁদ ছিল না। আদিষ্ট হয়ে নানা ভূমিকায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে বাধ্য হলেও মানুষ আকবর আলি খান কখনো নিজেকে হারিয়ে যেতে দেননি। শক্তিধর সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি আজীবন দায়িত্ব পালন করে গেছেন, অথচ একই সঙ্গে তিনি সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেয়ে গেছেন। তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দিক থেকে যাঁদের সঙ্গে তাঁর মতের অমিল হয়েছে তাঁরা কেউ দাবি করেননি যে, তিনি ক্ষমতা দেখিয়ে যুক্তিটি নিজের দিকে নিয়ে গেলেন। তিনি সরকারি কর্মকর্তার একটি আদর্শ রূপ নিজের ভূমিকার মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পেরেছিলেন। তিনি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন, একই সঙ্গে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হতে পেরেছিলেন।’

‘নানা কারণে আকবর আলি খানের সঙ্গে আমার পরিচয় তাঁর ছাত্র জীবন থেকে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ হলো যখন তিনি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হলেন। তখন তিনি একই সঙ্গে সরকারের অর্থসচিবও। ১৯৯১ সালের শেষ দিক থেকে ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এর আগে কোন চেয়ারম্যান এত দীর্ঘ সময় ধরে এই দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পাননি। তিনি দ্রুত গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডকে নিজের প্রিয় কর্মকাণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করল, আমাদের চিন্তাভাবনা তাঁকে আকৃষ্ট করল। ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে উদ্দীপনা আসলো। কখনো তাঁর উৎসাহে, কখনো তাঁর সমর্থনে আমরা গ্রামীণ ব্যাংকে নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নিতে পেরেছিলাম। সেগুলি পরবর্তীতে স্থায়ী রূপ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংককে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস লিখেছেন, ‘প্রত্যেকটা বোর্ড মিটিং আমাদের জন্য আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতো। আকবর আলি খান দেশের মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটার পরিচয় পেতাম যখন তিনি গ্রামের গরিব মহিলাদের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি বিষয়ে মনোযোগ দিতেন এবং তাঁদের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য নানা চিন্তার অবতারণা করতেন।’

স্ট্যাটাসে আরও লেখা হয়েছে, ‘আকবর আলি খানের বিদায়ে আমরা সর্ববিষয়ে জাতির মঙ্গলকামী এমন একজন মানুষকে শুধু নয় বরং কর্ম ও চিন্তার সর্ব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারে এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ প্রখরবুদ্ধি সম্পন্ন সৎ ব্যক্তিকে হারালাম। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন। নতুন প্রজন্ম যেন তাঁর পদচিহ্ন এবং চেতনাচিহ্ন অনুসরণ করতে উদ্দীপ্ত হয় এই কামনা করছি।’

গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর রাজধানীর একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন ড. আকবর আলি খান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। আজ শুক্রবার বেলা তিনটার পরে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার সদস্যসহ বিশিষ্টজন শোক জানিয়েছেন।

আকবর আলি খান ১৯৪৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে জন্ম নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং পিএইচডি করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হবিগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে হবিগঞ্জ পুলিশের অস্ত্র সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং তাঁদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেন। মুজিবনগর সরকার তখনও প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় অনেক সরকারি কর্মচারীই লিখিত অনুমতি ছাড়া অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে আকবর আলি খান নিজ হাতে লিখিত আদেশ তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র, খাদ্য ও অর্থ জোগান দেওয়ার আদেশ দেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তহবিল তৈরি করতে ব্যাংকের ভল্ট থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা উঠিয়ে ট্রাকে করে আগরতলায় পৌঁছে দেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য জোগান দেওয়ার জন্য গুদামঘর খুলে দেন এবং পরে আগরতলায় চলে যান। এ অপরাধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই তাঁর বিচার করে পাকিস্তান সরকার। বিচারে তাঁর ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।

দেশ স্বাধীন হলে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সচিবালয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। তিনি সেখানে ছয় মাস চাকরি করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান থেকে ফেরত ব্যক্তিদের চাকরি পেতে সহায়তা করেন। পরে তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

২০০৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা ছিলেন। পরে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে না- এমন শঙ্কায় তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে একযোগে পদত্যাগ করেন তিনি। আকবর আলি খান রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া তিনি অধ্যাপনা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েও।

তার প্রকাশিত মোট গ্রন্থের সংখ্যা ১৭টি। তাঁর জনপ্রিয় প্রকাশনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- পরার্থপরতার অর্থনীতি, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য : একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, দুর্ভাবনা ও ভাবনা : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, ডিসকভারি অব বাংলাদেশ, ফ্রেন্ডলি ফায়ারস, হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার অ্যান্ড আদার এসেস, গ্রেশাম’স ল সিন্ড্রম অ্যান্ড বিঅন্ড, দারিদ্র্যের অর্থনীতি : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, চাবিকাঠির খোঁজে : নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন ইত্যাদি। আকবর আলি খানের সর্বশেষ আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। সর্বশেষ গত ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ মিলনায়তনে আবুল মনসুর আহমদের ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর : পাঠ ও পর্যালোচনা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App