×

জাতীয়

মোবাইল ব্যাংকিং ঘিরে সক্রিয় অপরাধীচক্র

Icon

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০১৮, ১০:৪৭ এএম

মোবাইল ব্যাংকিং ঘিরে সক্রিয় অপরাধীচক্র
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ঊর্ধ্বতন পদে চাকরি করেন মাসুমা আক্তার (ছদ্মনাম)। অফিস শেষে প্রতিদিনের মতো বাসায় ফিরে আসেন। হঠাৎই তার মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন, আপু আপনি কি মাসুমা আক্তার বলছেন? হ্যাঁ বলতেই, আপু আমি বিকাশ হেড অফিস থেকে অর্ণব চৌধুরী বলছি। আপনার জন্য একটি সুখবর আছে। আপনি তো খুব ভাগ্যবান। কিসের সুখবর জানতে চাইলে ওপাশ থেকে বিস্তারিত বলা শুরু। আপা বছর পূর্তি উপলক্ষে বিকাশ রি-রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। এই রি-রেজিস্ট্রেশন তালিকা থেকে ১০টি নাম্বারকে লটারির মাধ্যমে পুরস্কৃত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত পরশু লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটি বিটিভি সরাসরি সম্প্রচারও করে। এই ১০টি নাম্বারের তালিকায় ১ নাম্বারে আছে আপনার ফোন নাম্বার। সুতরাং আপনিই হচ্ছেন আমাদের এবারের বিজয়ী। শু-স্বাগতম আপা আপনাকে। পুরস্কার হিসেবে বিকাশের পক্ষ থেকে আপনি পাচ্ছেন ২১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। মুহূর্তের মধ্যেই টাকার লোভ পেয়ে বসে মাসুমাকে। তার চোখে তখন শুধুই ২১ লাখ টাকা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর কিছু ভাবার সময় নেই তার। কীভাবে টাকা পাওয়া যাবে? মাসুমার এমন প্রশ্নে ওপার থেকে, দেখুন আপু এত বড় একটি পুরস্কার আপনি পেতে যাচ্ছেন, কিন্তু এর জন্য আপনাকে কিছু ফরমালিটিস মেইনটেইন করতে হবে। তা না হলে পুরস্কারটি পাবেন না। কি ফরমালিটিস জানতে চাইলে, আপনাকে টাকাটা পেতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট হিসেবে কিছু টাকা আগাম পরিশোধ করতে হবে। এরপর মাসুমা আক্তারের কাছ থেকে ৩ মাস ধরে ইনকাম ট্যাক্স, বিটিসিএলের ফিসহ নানা বাহানায় মোট ৪২টি বিকাশ নাম্বারের মাধ্যমে নেয়া হয় ৪০ লাখ টাকা। ৩ মাস পরেও পুরস্কার না পেয়ে মাসুমা বুঝতে পারেন তিনি একটি চক্রের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন। ঘটনা-২ : রাজধানীর হাবিবুল্লাহ বাহার ইউনিভার্সিটি কলেজের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ওলিউল্লাহ (ছদ্মনাম)। ক্লাস শেষ করে তিনি রামপুরার বাসায় ফিরছিলেন। এরই মধ্যে একদল দুর্বৃত্ত তাকে মাইক্রোবাসে তুলে অপহরণ করে। যখন জ্ঞান ফেরে তখন তিনি গাজীপুরের একটি নির্জন এলাকায় একটি গাড়ির মধ্যে হাত পা বাঁধা অবস্থায় নিজেকে আবিস্কার করেন। তাকে বসিয়ে রেখেছে তিন দুর্বৃত্ত। জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তারা কাছে এগিয়ে এসে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখায়। এরপর তার বাবাকে ফোন দিয়ে ১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে বলে। না দিলে মেরে ফেলা হবে এমন ভয়ে ওলিউল্লাহ তার বাবাকে ফোন দিয়ে বলে, আব্বু কে বা কারা আমাকে অপহরণ করেছে। ১ লাখ টাকা না দিলে মেরে ফেলবে। ওলিউল্লাহর বাবা আবুল খায়ের নিজের জমি বন্ধক রেখে ১ লাখ টাকা জোগাড় করেন। কীভাবে পাঠাতে হবে- জানতে চান। এরপর দুর্বৃত্তরা ১০টি বিকাশ নাম্বার দিয়ে ১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ওলিউল্লাহকে ওই স্থানে রেখে পালিয়ে যায়। শুধু মাসুমা আক্তার কিংবা ওলিউল্লাহ নয়, বিভিন্ন পন্থায় প্রতারিত হয়ে প্রতিদিনই লাখ টাকা হারাচ্ছেন প্রশাসনিক লোকসহ সাধারণ গ্রাহকরা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে অপহরণ করেও বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ভুয়া ক্যাশ-ইন এসএমএস, বিকাশের স্টাফ ও ডিস্ট্রিবিউটর পরিচয়ে বিভিন্নভাবে ব্লু্যাকমেইল, কল ডাইভার্ড, বিভিন্ন বামপার অফার দেয়া, মোবাইল পরিবর্তন, জীনের বাদশা পরিচয়ে, অপহরণ, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক, বিমানবন্দরে লাগেজ থেকে নাম-ফোন নাম্বার নেয়া অথবা বিমান যাত্রীর স্বজনদের ফাঁদে ফেলাসহ কমপক্ষে ১৫টি অভিনব পন্থায় প্রতারিত হচ্ছেন বিকাশ গ্রাহকরা। ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও মধুখালিতে গড়ে উঠেছে এ ধরনের সংঘবদ্ধ চক্র। প্রতারক চক্র ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করায় তাদের নাগাল পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে, লোভের দিকে পা না বাড়িয়ে একটু সচেতন হলেই প্রতারক চক্র কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, হুন্ডি ব্যবসা ও ডিব্বা সিমের (১৫০-২০০ সিম) মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনসহ মাদকের ৯৫ শতাংশ টাকা এমনকি খুন করার টাকাও লেনদেন হচ্ছে বিকাশে। অনেক সময় বিকাশ এজেন্টরা নিজেরাই প্রতারিত হচ্ছেন বিভিন্ন প্রতারক চক্রের মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদ, মাদক ও সাইবার ক্রাইমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিকাশের মাধ্যমে যে প্রতারণাগুলো হচ্ছে সেগুলোকে সাইবার অপরাধ বলা চলে। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাইবার ক্রাইম ইউনিটকে ঢেলে সাজাতে হবে। এ ছাড়া যে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে আরো গবেষণাধর্মী ও সচেতন হতে হবে। সিআইডি সূত্র জানায়, আমাদের দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ লেনদেনই বিকাশের মাধ্যমে হয়। সুতরাং, বিকাশ গ্রাহকদের বিভিন্ন ফাঁদে ফেলে প্রতারিত করছে বিভিন্ন চক্র। এ ছাড়া বর্তমানে মাদক ব্যবসার লেনদেন, অপহরণ, অবৈধ ট্রানজেকশনসহ বিভিন্ন অপরাধে বিকাশের অপব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহকদের পরিচয়পত্র ভুয়া হওয়ায় প্রতারকদের চিহ্নিত করা যায় না। বিকাশের ৮০ শতাংশ এজেন্টও বিভিন্ন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন অভিযানে গ্রেপ্তারকৃত এজেন্টদের কাছে ডিব্বা সিম পাওয়া গেছে। এই সিমগুলো ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন অবৈধ লেনদেন করে থাকে। বর্তমানে বিকাশসংশ্লিষ্ট প্রতারণার ৮টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। বিকাশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক বিকাশ এজেন্ট অধিক লাভের আশায় অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তবে উপযুক্ত প্রমাণ পেলে তাদের অ্যাকাউন্ট বাতিল করা হয়। হুন্ডি করার বিষয়ে বলেন, বিদেশে মানি ট্রানজিট সেন্টারগুলোতে তেমন সুবিধা না থাকায় গ্রাহকরা বিভিন্ন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। এনআইডি ভেরিফিকেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিকাশের বর্তমান গ্রাহক প্রায় ৩ কোটি। আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা না থাকা ও ইসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে না পারায় লাখ লাখ অ্যাকাউন্টের ভেরিফিকেশন হয়নি। গত ২ মাস ধরে ইসির সমন্বয়ে এনআইডি ফেরিফিকেশন হলেও এত সংখ্যক অ্যাকাউন্টের ফেরিফিকেশন প্রায় অসম্ভব। র‌্যাব সদর দপ্তর সূত্র জানায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে প্রতারণার অভিযোগে ২০১৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত ১৪টি অভিযানে ৫৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রতারক চক্রের মধ্যে বেশির ভাগই রাজধানীর আশপাশে ও ফরিদপুর জেলার। যেহেতু বিকাশ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেহেতু এরা প্রতারণার মাধ্যম হিসেবে বিকাশকে বেছে নেয়। র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যে প্রতারণাগুলো হচ্ছে এর জন্য দায়ী গ্রাহক নিজেই। কারণ লোভ লালসায় পড়ে তারা বিভিন্ন ফাঁদে পা দেন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রতারকরা আগেও ছিল, এখনো আছে। দেশ যত উন্নত হবে প্রতারণার ধরন তত বাড়বে। তবে, ছোট প্রতারণার ক্ষেত্রে তেমন কেউ অভিযোগ করেন না। আমরা যে অভিযোগ পাই সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করি। সিটিটিসির মোবাইল ফিন্যান্স সিকিউরিটিস টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. আজহারুল হক মুকুল ভোরের কাগজকে বলেন, গত বছরের জুন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের কাছে এ ধরনের ৪১টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহকরা লোভে পা বাড়িয়েছে। যেহেতু প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে ভুয়া তথ্য থাকে সেহেতু গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বিকাশের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন বেশি হওয়ায় এজেন্টরা হুন্ডির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। বিদেশে তারা ছোট সাইনবোর্ড টানিয়ে অর্থ জমা নিয়ে বিকাশ নাম্বার নিচ্ছে। এরপর বিভিন্ন অ্যাপস ব্যবহার করে গ্রাহকের নাম্বারে বাংলাদেশি এজেন্ট সমপরিমাণ টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে। শুধুমাত্র এই কারণে ২০১৬ সালে ১৩ শতাংশ রেমিট্যান্স কমে যায়। পরে বিষয়টি বিকাশ কর্তৃপক্ষকে জানালে তারাও নড়েচড়ে বসে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০০ এজেন্ট নাম্বার দিয়ে সহযোগিতা করে। পরে ২ হাজার ৮৮৭ জনের তালিকা সিআইডির কাছে পাঠানো হয়। পরে সিআইডি বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করায় এ ধরনের অর্থপাচার কমে আসছে। এখন রেমিট্যান্স আবারো ঊর্ধ্বমুখী। বিকাশের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু যে বিকাশের মাধ্যমে প্রতারণা হয় ব্যাপারটা তেমন নয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একটি চক্র এ ধরনের ফাঁদ তৈরি করছে। তবে, এর জন্য দায়ী গ্রাহক নিজেই। এ ক্ষেত্রে শুধু সচেতন হলে প্রতারকরা ফাঁদে ফেলতে পারবে না। অবৈধভাবে বিদেশি অর্থপাচারের বিষয়ে বলেন, বিদেশ থেকে সরাসরি বিকাশে কোনো টাকা আসে না। কোনো গ্রাহক বা এজেন্টকে সন্দেহ হলে আমাদের একটি ইউনিট ‘সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট’ তৈরি করে। পরে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়। ভোটার আইডি ভ্যারিফিকেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে এনআইডি ভ্যারিফিকেশন করছি। সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের উপপুলিশ কমিশনার মো. অলিমুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতারক চক্র থেকে রক্ষা পেতে সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। প্রতারকরা আবেগি কথা বলে, ব্লু্যাকমেইল করে, হুমকি দিয়ে টাকা নেয়ার চেষ্টা করবে। তাদের ফাঁদে পা না দিয়ে এ ধরনের ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর অনুরোধ করেন তিনি।
4

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App