×

জাতীয়

দলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০০ এএম

দলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই!

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের

সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে ফের শুরু হয়েছে ক্ষমতার লড়াই। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মূলত দলটিতে এই গৃহবিবাদের সূত্রপাত। জাতীয় পার্টিতে বর্তমানে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দলটির প্রয়াত চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্ত্রী রওশন ও ভাই জি এম কাদের আবারো মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। মূলত, দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে গত আড়াই দশক ধরে চলা দেবর-ভাবির এ দ্বন্দ্ব এরশাদের মৃত্যুর আগে খুব বেশি প্রকাশ্যে না এলেও বর্তমানে তা দৃশ্যমান লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে। সবশেষ, গত বুধবার হঠাৎ করে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বিদেশ থেকে চিঠি দিয়ে আগামী নভেম্বরে দলের কাউন্সিল ডাকলে এই মতবিরোধ দেখা দেয়। তবে দলের একটি সূত্রের আশঙ্কা, জাপায় অন্তর্দ্ব›দ্ব চাঙ্গা হয়ে উঠার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনও ধাকতে পারে।

জানা যায়, দলের কাউন্সিল আহ্বান করে রওশন চিঠি দেয়ার পরই পার্টির মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়। এরপর দলের কাউন্সিল ডাকার চিঠি প্রত্যাহার করতে যোগাযোগ করা হয় থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদের সঙ্গে। কিন্তু তিনি চিঠি প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় তাকে সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার পদ থেকে বাদ দিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতার স্বীকৃতি দিতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিনকে গত বৃহস্পতিবার চিঠি দিয়েছে জাপার সংসদীয় দল। জি এম কাদের বর্তমানে সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার পদে রয়েছেন। স্পিকারের অনুমোদন পেলে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিরোধী দলীয় নেতার আসনে বসবেন। বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা বৃহস্পতিবার সংসদ অধিবেশনের মাগরিবের নামাজের বিরতিতে কার্যালয়ে গিয়ে স্পিকারকে এই চিঠি দেন। এ সময় জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, আহসান আদেলুর রহমানসহ আরো কয়েকজন সংসদ সদ্য উপস্থিত ছিলেন। এর আগে সংসদ ভবনে জাপার সংসদীয় দলের সভা হয়। মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, জাপার ২৬ সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৩ জন সভায় উপস্থিত ছিলেন। তারা বিরোধীদলীয় নেতার পদে জি এম কাদেরকে সমর্থন দিয়েছেন।

একজন এমপি টেলিফোনে জি এম কাদেরের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। তবে রওশন এরশাদ দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদ সদস্য পদে থাকবেন।

বিদেশ থেকে পাঠানো রওশন এরশাদের চিঠিতে আগামী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে কাউন্সিলের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। চিঠিতে রওশন নিজেকে কাউন্সিলের প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ঘোষণা করেন। জাপা তাৎক্ষণিক বিবৃতিতে দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের চিঠিকে অবৈধ, অনৈতিক ও গঠনতন্ত্র পরিপন্থি আখ্যা দেয়। পরের দিন জি এম কাদের বলেন, কোনো ষড়যন্ত্রই দলের ঐক্যে ফাটল ধরবে না। এরশাদের সৈনিকরা বিভ্রান্ত হবেন না। সংসদীয় বৈঠকের আগে বৃহস্পতিবার বনানী কার্যালয়েও জাপার দলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক থেকে রওশনকে টেলিফোনে আলটিমেটাম দিয়ে ভিডিওবার্তা দেয়া হয়, সংবাদ সম্মেলন বা বাহকের মাধ্যমে চিঠি প্রত্যাহার না করলে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু তিনি কিছুতেই চিঠি প্রত্যাহারে রাজি হননি। এ বিষয়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, রওশন এরশাদ চিঠি প্রত্যাহারের অনুরোধে রাজি হননি। তিনি বছরখানেক ধরে অসুস্থ থাকায় সংসদীয় কার্যক্রমে সক্রিয় নন। একজন সার্বক্ষণিক বিরোধীদলীয় নেতা প্রয়োজন। সে কারণেই জি এম কাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে। জাপার সংসদ সদস্যদের মধ্যে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে রাহগীর আল মাহি এরশাদ সাদ বাদে বাকিরা জি এম কাদেরকে সমর্থন করেছেন।

এ বিষয় জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের বলেছেন, রওশন এরশাদের নামে তৃতীয়পক্ষ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাতে চাচ্ছে। তবে, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা পার্টির বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবে না। গতকাল শুক্রবার দুপুরে উত্তরায় নিজ বাসভবনে এসব কথা বলেন তিনি। জাপা চেয়ারম্যান বলেন, কখনো কখনো রওশন এরশাদকে দিয়ে কিছু মহল এমন কিছু বক্তব্য, বিবৃতি ও বিজ্ঞপ্তি দেয়ার ব্যবস্থা করছেন- যা সার্বিকভাবে দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। জাতীয় পার্টির সংসদীয় কমিটির সদস্যরা মনে করছেন অসুস্থতা ও বয়সের কারণে তিনি বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ভোট বর্জন করলেও রওশনের নেতৃত্বে জাপার একাংশ অংশ নিয়ে ৩৪ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রওশন হন বিরোধীদলীয় নেতা। আর ২০১৮ সালের একাদশ সংসদের শুরুতে এরশাদ নিজেই বিরোধীদলীয় নেতার পদে বসেন। ছোট ভাই জি এম কাদের উপনেতা বানান। দুই মাসের মাথায় ভাইকে সরিয়ে স্ত্রীকে উপনেতা করেন। এরশাদের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে জি এম কাদের বিরোধী দলীয় নেতা হতে চেয়ে ১৮ এমপির স্বাক্ষরসহ স্পিকারকে চিঠি দেন। বিদ্রোহ করেন রওশন এরশাদ। ওই সময় তার পক্ষে ছিলেন দলের কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তৎকালীন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমামসহ আরো অনেকেই। পরে দুই পক্ষের সমাঝোতায় ভাবি রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে মেনে নেন জিএম কাদের। দেবর জি এম কাদেরকে জাপার চেয়ারম্যান পদে মেনে নেন রওশন। তবে এবার রওশনের পক্ষে কেউ নেই। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মসিউর রহমান রাঙ্গা, ফখরুল ইমামসহ সব সংসদ সদস্য জি এম কাদেরের পক্ষে। গত বুধবার রওশন এরশাদের পাঠানো চিঠিতে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, এবিএম রুহুল আমিনসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদ দিয়েছিলেন। যদিও তারা সবাই রওশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, রওশন এরশাদ সবার কাছে সম্মানিত। কিন্তু অসুস্থ। তাকে দিয়ে জাপার কয়েকজন সাবেক ও বহিষ্কৃত নেতা বিভিন্ন ঘোষণা দেয়াচ্ছেন। তবে এরশাদপত্নী রওশনকে বহিষ্কার করা হবে না বলে জাপা সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই সূত্র জানায়, সরকারের সহানুভূতি ও সমর্থন রয়েছে রওশনের প্রতি। তাকে সরিয়ে স্পিকার জি এম কাদেরকে বিরোধী দলীয় নেতার স্বীকৃতি শিগগির নাও দিতে পারেন। থাইল্যান্ড থেকে রওশনের চিঠি নিয়ে দেশে আসেন তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ। তাকে কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব করেছিলেন রওশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App