×

জাতীয়

অস্বস্তি থাকলেও দায় নিতে রাজি নয় বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ আগস্ট ২০২২, ১২:০২ এএম

অস্বস্তি থাকলেও দায় নিতে রাজি নয় বিএনপি

ফাইল ছবি

বিএনপির কেউই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জড়িত নয়- প্রকাশ্যে এমনই শক্ত অবস্থান থাকলেও ভেতরে ভেতরে বেশ অস্বস্তি রয়েছে দলটির। বিএনপি নেতাদের মতে, ওই ঘটনার পর বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। কমিশনের প্রতিবেদন জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য করা যায়নি। কারণ বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ভাবমূর্তির সংকট ছিল। তারা মনে করেন, ওই সময়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করা গেলে পরবর্তী সময়ে ঘটনার সঙ্গে তারেক রহমানকে জড়ানো যেত না।

এদিকে ২১ আগস্ট ঘনিয়ে এলে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতার অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। কারণ ঘটনার সময়কার অনেক প্রশ্নের জবাবই দিতে পারেন না তারা। নেতাদের দাবি- ঘটনার পর দল সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে। বরং ঘটনার শিকার আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই কোনো সহযোগিতা পায়নি তৎকালীন সরকার।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে দেড় দশক আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংঘটিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি স্থায়ী বিভক্তি রেখা টেনে দিয়েছে। এই ঘটনাটি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে জন্ম দিয়েছে অবিশ্বাস এবং চিরকালীন শত্রুতা। তারা বলেছেন, ১৯৯১-১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে খালেদা জিয়ার এবং ১৯৯৬-২০০১ সালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার আচরণ খুব একটা কঠিন ছিল না। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর সব হিসাব বদলে দেয়। এ হামলার কারণেই তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না।

এ বিষয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপির অনেক ভুল আছে, যা অমার্জনীয়। তবে ২১ আগস্টের ঘটনা বিএনপিকে দুর্বল করেছে। পাশাপাশি ওই ঘটনা রাজনীতিতে স্থায়ী অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। ওই ক্ষত রাজনীতির পারস্পরিক ন্যূনতম বোঝাপড়ার জায়গাটিও নষ্ট করে দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ২১ আগস্ট নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের মুখ বন্ধ রাখতে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাই তো হামলার ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় পরও এই ইস্যুতে বরাবরই মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন বিএনপি নেতারা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এমন নৃশংস হামলার ঘটনায় দলের ইমেজ নষ্ট হয়েছে এবং জঙ্গিবাদকে সমর্থন দেয়ায় আঞ্চলিকসহ আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়েছে বলেও মনে করে দলটির একটি অংশ।

প্রতি বছর ২১ আগস্ট এলেই হামলার দায় এড়াতে ঘটনার পেক্ষাপট তুলে ধরে বিএনপির নেতারা বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করান। হামলার ঘটনা নিয়ে আলাপকালে নেতারা জানান, ওই সময়ে গ্রেনেড হামলার সঠিক তথ্যদানকারীকে এক কোটি টাকা পুরস্কারের ঘোষণা জোট সরকারের তরফ থেকেই করা হয়েছিল। হামলার দিন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বিবৃতি দিয়ে হামলার নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হামলায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে একটি চিঠিও লেখেন। পাশাপাশি হামলার কয়েকদিন পর খালেদা জিয়া সংলাপে বসার আগ্রহ দেখালেও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়। বলা হয়, খুনির সঙ্গে কীসের সমঝোতা? বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা সে সময় বলেন, ‘আমাকে যে খুন করতে চেয়েছে তার সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয়।’ আর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেয়া মামলার রায় প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বলছে, ওই রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সাজানো।

সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা। এছাড়া মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার, তদন্তের জন্য এফবিআই ও ইন্টারপোলকে নিয়ে আসা এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন বিএনপি সরকারের সময়েই হয়েছে বলেও তারা যুক্তি দিচ্ছেন। তাদের অভিযোগ- মুফতি হান্নানকে দিয়ে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও আওয়ামী লীগের বাধায় সেটি সম্ভব হয়নি।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২১ আগস্ট হামলার ঘটনা ভয়াবহ এবং হতাহতের ঘটনা মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক। তবে বিএনপির কেউ জড়িত নন। তিনি বলেন- খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ বিএনপিকে ধ্বংস করার সুদূরপ্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্যই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় বিএনপিকে জড়ানো হয়েছে। ওই মামলায় সঠিক তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসত। তিনি বলেন, এক-এগারো সরকারের আমলে দেয়া অভিযোগপত্রেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আবদুল কাহার আকন্দকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তারেক রহমানের নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে এটিকে ইস্যু করে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছে।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে বিএনপিতে অস্বস্তি : জোট সরকার আমলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়েও বিএনপির মধ্যে অস্বস্তি আছে। দলটির নেতাদের পাশাপাশি সুধী-সমাজেরও অনেকে মনে করেন, বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনও ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ওই কমিশনের প্রতিবেদন জনগণের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য করা যায়নি। কারণ বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের ভাবমূর্তির সংকট ছিল। ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের কমিশন সরকারের কাছে দাখিলকৃত প্রতিবেদনে এই গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হাত ছিল বলে উল্লেখ করে। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা বলতে সে সময় ভারতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু এর ফলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

ঘটনার সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ছাড়াও সেই সময়ের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা গ্রেনেড হামলা-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক নেতারা পরিপূর্ণভাবে অন্ধকারে ছিলেন বলে পরবর্তী সময়ে জানা যায়। দলটির অনেকে মনে করেন- বাবর, হারিছ ও সালাম পিন্টুর ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই তারেক রহমান ফেঁসে গেছেন।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমাদের সরকারের আমলে তদন্ত করে দোষীদের শনাক্ত ও বিচার করা গেলে বিএনপিকে ধ্বংস করার যে খেলা আজ আওয়ামী লীগ খেলছে সেই সুযোগ পেত না। তিনি বলেন, ২১ আগস্টের ঘটনা শেখ হাসিনাকে হত্যার চক্রান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই চক্রান্ত ছিল সেদিন জাতীয়তাবাদী বিএনপির নেতৃত্বকে কবর দেয়া, যা রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে বিএনপির ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে।

জজ মিয়া ‘নাটক’-এর কোনো জবাব নেই বিএনপির কাছে : বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতার কাছে জানতে চাইলেও জজ মিয়া প্রসঙ্গে তারা প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, মামলার পুনঃতদন্ত, সম্পূরক চার্জশিট এমনকি রায় নিয়েও আমরা কিছু কথা বলতে পারছি। কিন্তু জজ মিয়ার বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। তারা বলেন, আওয়ামী লীগ সারাজীবন অভিযোগ করত বিএনপি গ্রেনেড হামলা করেছে। আর আমরা বলতাম করিনি। এভাবে রাজনীতির সময় পার করা যেত। কিন্তু জজ মিয়া নাটক নিয়ে আমরা কী বলব! তবে জজ মিয়া নাটকের বিষয়ে আজ পর্যন্ত যৌক্তিক কোনো জবাব বিএনপির কাছ থেকে আসেনি।

পরিবারকে টাকা দিয়ে নোয়াখালীর জজ মিয়াকে আসামি করে তার কাছ থেকে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে সিআইডির স্বীকারোক্তি আদায়ের ঘটনা ‘জজ মিয়া নাটক’ হিসেবে পরিচিত। গণমাধ্যমে ফাঁস হয়- বিষয়টি পুলিশের সাজানো ছিল। বিষয়টি নিয়ে লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমে বলেন, ২১ আগস্ট নিয়ে বিএনপির অস্বস্তি থাকা স্বাভাবিক। কারণ ক্ষমতায় থাকতে পুরো বিষয়টি তারা তদন্ত না করে উপেক্ষা করেছে এবং জজ মিয়া স্টোরি সাজিয়েছে। তা ছাড়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে পুরো বিষয়টি কাঁধে নিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App