×

জাতীয়

এমপিওভুক্তিতে আওয়ামী প্রাধান্য!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২২, ০৮:৫১ এএম

এমপিওভুক্তিতে আওয়ামী প্রাধান্য!

প্রতীকী ছবি

# তদবিরে শর্ত শিথিল # কমিটির সদস্যদের মুখে কুলুপ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌরশহরের একমাত্র মহিলা কলেজটির নাম ছিল ‘নাছরীন নবী পাইলট বালিকা স্কুল এন্ড কলেজ’। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখাকে আলাদা করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মায়ের নামে ‘জাহানারা হক মহিলা কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাত্র চার বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানটি সদ্যঘোষিত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ পর্যায়ের এমপিওভুক্তির তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে।

বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ নামে একটি সংগঠনের সভাপতি ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ। তিনি নিজেই নিজের নাম দিয়ে ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় লাউর ফতেহপুর ব্যারিস্টার জাকির আহাম্মদ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার আট বছরের মাথায় প্রতিষ্ঠানটিও সদ্যঘোষিত কলেজ পর্যায়ের এমপিওভুক্তির তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে। একইভাবে হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট আবু জাহিরের স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠিত আলেয়া জাহির কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। ২০১১ সালে হবিগঞ্জের জালালাবাদ এলাকায় এডভোকেট আবু জাহির স্ত্রীর নামে এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার ১২ বছরের মাথায় কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়েছে। ভোলার মনপুরায় আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব কলেজ, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আব্দুস শহীদ কলেজও প্রতিষ্ঠার কম সময়ের মধ্যেই এমপিওভুক্ত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ৬ জুলাই সরকার চলতি অর্থবছরে নিম্ন মাধমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল, কৃষি ও কারিগরি স্তরের ২ হাজার ৭১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করে। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ৯৫টি কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে। এই ৯৫টি কলেজের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, বেশ কিছু শর্ত শিথিল করে আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে প্রতিষ্ঠিত অর্ধশতাধিক কলেজকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে বলে ভোরের কাগজ জানতে পেরেছে। শুধু কলেজই নয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের নামে প্রতিষ্ঠিত মাধ্যমিক স্কুলও এমপিওভুক্তি পেয়েছে বলে তালিকা ঘেঁটে জানা গেছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম হাইস্কুল, ভৈরবে জিল্লুর রহমান স্কুল এন্ড কলেজ, ময়মনসিংহে বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ উল্লেখযোগ্য।

এসব প্রতিষ্ঠান ঘোষিত নীতিমালা মেনেই এমপিওভুক্ত হয়েছে কিনা তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তা বলতে পারেননি। বিশেষ করে এমপিওভুক্তি সংক্রান্ত যে কমিটি রয়েছে সেই কমিটির সদস্যরাও এ বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। তাদের একটি কথা, এমপিওভুক্তি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে তারা কিছু বলবেন না। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিই সেদিন সংবাদ সম্মেলন করে যা বলার বলে দিয়েছেন, নতুন করে তাদের বলার কিছু নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, এমপিওভুক্তির জন্য ঘোষিত নীতিমালা থাকলেও কিছু প্রতিষ্ঠানকে তদবিরে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। তবে এই সংখ্যাটি কত, তা তিনি জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, গত এমপিওভুক্তির তালিকা প্রকাশের পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী ও বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের নামে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়েছিল। এবার যাতে এমনটি না হয় সেজন্য আগেভাগেই জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাড়ি-নক্ষত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। এর ফলে এবারের তালিকায় স্বাধীনতাবিরোধী ও জামায়াত-রাজাকারদের নামে কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হয়নি। তবে কোথাও বিএনপির নেতাদের নামে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও হতে পারে বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপিওভুক্তির ঘোষণার দিনে বলেন, বহু জায়গায় শর্তানুযায়ী এমপিওভুক্ত করার জন্য যোগ্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায়নি। এজন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে শর্ত শিথিল করে কিছু প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেয়া হয়েছে। গত এমপিওভুক্তির পর ২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, এবার তা হয়নি বলে জানান তিনি। নীতিমালার শর্ত তুলে ধরে গত ৬ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী জানান, ২০২১ সালের নীতিমালা অনুযায়ী এমপিও প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যারা শর্ত পূরণ করতে পেরেছে সেসব প্রতিষ্ঠানের সবই এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। তবে শর্ত পূরণ করতে না পারায় যে উপজেলায় কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সুযোগ পায়নি, সেসব উপজেলার একটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে যোগ্যতা ধরা হয়েছে ওই উপজেলার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরকে।

নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্য বিবেচিত না হলেও ১২৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শর্ত শিথিল করে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১০টি স্কুল ও কলেজ, ১৩টি মাদ্রাসা ও ৪টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ৫৪টি উপজেলা ও থানার কোনো স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করেনি। এর মধ্যে ৩২টি উপজেলা ও সিটি করপোরেশনভুক্ত ২২টি থানার কোনো স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। আর ১৮টি উপজেলার কোনো স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্তির আবেদন করেনি। অপর দিকে ২০০টি উপজেলার থেকে কোনো মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এর মধ্যে ১৫২টি উপজেলার কোনো মাদ্রাসা এমপিওভুক্তির আবেদন করেনি। আর ২২৩টি উপজেলার কোনো কারিগরি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য যোগ্যতা অর্জন করেত পারেননি। ২১৩টি উপজেলার কোনো কারিগরি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির আবেদন করেনি। তবু এমপিওভুক্ত হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যোগ্যতা সাপেক্ষেও কোনো প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক তালিকা থেকে বাদ গেছে মনে করলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও কমিটির সভাপতির যৌথ স্বাক্ষরে ১৫ দিনের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব বরাবর আবেদনের মাধ্যমে আপিল করতে পারবে। ১৫ দিনের মধ্যে শুনানি গ্রহণ করে মন্ত্রণালয় আপিল নিষ্পত্তি করবে। নতুন এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচিত স্কুল কলেজের মধ্যে ৬৬৬টি নি¤œ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১ হাজার ১২২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩৬টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০৯টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ, ১৮টি ডিগ্রি কলেজ। কারিগরি এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আওতাভুক্ত ৬৬৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এসএসসি ভোকেশনাল অথবা দাখিল ভোকেশনাল ৯৭টি, এইচএসসি বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এন্ড টেকনোলজি ২০০টি, ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার দুটি, দাখিল মাদ্রাসা ২৬৪টি, আলিম মাদ্রাসা ৮৫টি, ফাজিল মাদ্রাসা ৬টি, কামিল মাদ্রাসা ১১টি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App