×

জাতীয়

প্রস্তুতির অভাবে জ্বালানি সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২২, ০৮:৩০ এএম

প্রস্তুতির অভাবে জ্বালানি সংকট

প্রতীকী ছবি

সময়োচিত প্রস্তুতি-পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার অভাবেই বাংলাদেশ এখন জ্বালানি সংকটের মুখে পড়েছে। সরকার এখন নতুন এবং পুরাতন গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে অনুসন্ধান শুরু করার কথা বললেও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই এই পরামর্শ দিয়ে আসছেন। কিন্তু তাদের কথায় তখন আমল দেয়া হয়নি। পেট্টোবাংলাকে দক্ষ জনবলে সমৃদ্ধ করার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা না বাড়াতেও তারা বারবার সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। তা আমলে নিয়ে পদক্ষেপগুলো আগে নেয়া হলে আজকের সংকটময় পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হতো।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের জ্বালানি পলিসি সঠিক নয়। ‘নিজস্ব জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার’ করাই সরকারের পলিসি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এটা না করে কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীর স্বার্থে এবং সরকারের সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠীর কারণে এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ায় দেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। সরকারের জ্বালানি বিভাগের কিছু লোকজন সরকারকে বুঝিয়েছে, দেশে গ্যাসের যে সমস্যা রয়েছে তা এলএনজি আমদানি করেই সমাধান করা সম্ভব, অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। এলএনজি দিয়েই সমস্যার সমাধান করা হবে। মূল সমস্যাটা এখানেই। এই কারণেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে। সরকার সবসময় বিদ্যুৎ সেক্টরের উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে।জ্বালানি সেক্টরের দিকে সেভাবে নজর দেয়নি। বাজেটে জ্বালানির জন্য কখনোই সেরকম বরাদ্দও রাখা হয়নি। একারণে আমাদের নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান হয়নি, আবিষ্কারও হয়নি। অনুসন্ধান না হওয়ায় উৎপাদনে ভাটা পড়েছে, সংকট প্রকট হয়েছে।

বর্তমান সংকট প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, প্রথমেই বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি দূর করতে হবে। পেট্টোবাংলার পেশাদার ও দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা স্বচ্ছতার অভাব সবচেয়ে বেশি। অপশাসন বিদ্যুৎ খাত গ্রাস করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সেক্টরে অদক্ষ ও অক্ষম ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। এখানে অপশাসন চলছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের শীর্ষ পদগুলোতে অদক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে- যারা এই সেক্টরের করণীয় সম্পর্কে জানে না। এ কারণে তারা অনুসন্ধান ও উৎপাদন না বাড়িয়ে আমদানিনির্ভর জ্বালানি সংগ্রহের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে যে টাকা দিয়েছিলাম সেই টাকা খরচ করে অব্যাহতভাবে ২০১০ সালে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন করতাম, ভোলার গ্যাস যদি ব্যবহার করতে পারতাম, ছাতকের গ্যাস যদি পেতাম তাহলে সংকট হতো না।

তিনি বলেন, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও লুটপাট আরো একটি বড় সমস্যা। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে- তাদের লোকজনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতাকে প্রশ্রয় দেয়ার কারণে। তাদের পরিকল্পনা দূরদর্শী হলে, দক্ষতা দেখাতে পারলে এই খাতকে আজ সংকটে পড়তে হতো না। তারপরও যারা পরিকল্পনা করে তারা যানে কোথায় কোথায় গ্যাস নেই, তখন কেন ব্যবস্থা নিল না। এটা তাদের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার কারণেই বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, দেশকে সংকটে পড়তে হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ানোর দোহাই দিয়ে তারা এখন পার পেতে চাইছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, দেশীয় জ্বালানির খোঁজ না করে এলএনজি আমদানির অন্যতম কারণ হচ্ছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। এলএনজি আমদানি হলে আমাদের ব্যবসায়ীরা বেশি লাভবান হয়। গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া চালালে ব্যবসায়ীদের তেমন লাভ নেই। এই ব্যবসায়ীরাই সরকারের ওপরে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। সরকার স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে পারেনি বলেই সংকট প্রকাশ পেয়েছে। তা না হলে তারা ফুরফুরে মেজাজেই থাকত। দেশের সম্ভাব্য স্থানে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা হলে আমাদের গ্যাসের উৎপাদন আরো কিছুটা হলেও বাড়ত। সেই গ্যাস এখন ব্যবহার করা যেত। এসব উদ্যোগ না নেয়া বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী।

তিনি আরো বলেন, দেশে খনিজ জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানে কখনোই জোরাল কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংকট উত্তরণের জন্য দেশীয় অনুসন্ধান ও উৎপাদন ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। সরকার গ্যাস অনুসন্ধানে ‘স্বল্প মেয়াদি’ ও ‘দীর্ঘ মেয়াদি’ পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হলে আজকের এই সংকট এতটা প্রকট হতো না।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সেক্টরে বর্তমান সংকট এবং উত্তরণের বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সরকারের শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত আলোচনা করেছি। এখন বেশি দামে গ্যাস না কিনে ডলার হাতে রেখে দেয়ার জন্যই আমরা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। এই টাকা তো জনগণের টাকা। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করে। টাকা হাতে থাকলে দাম কমলে তখন বেশি পরিমাণে কেনা যাবে। এই সংকট বেশি দিন থাকবে না। বর্তমান সমস্যা সাময়িক সমস্যা।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, বর্তমান সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য পেট্টোবাংলা নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। তবে রাতারাতি গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা পুরাতন গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছি। আমাদের প্রকৌশলীরা কাজ করছে। গ্যাস অনুসন্ধানে আমাদের কোনো রিগ বসে নেই। ইতোপূর্বে আমরা নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করেছি। কিন্তু ওই সময় কোনো সাড়া পাইনি। এছাড়া দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত একটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। আগামী বছরের শুরুতে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App