×

জাতীয়

লঞ্চ যাত্রায় স্বস্তি, সড়কে শঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২২, ০৮:০০ এএম

লঞ্চ যাত্রায় স্বস্তি, সড়কে শঙ্কা

প্রতীকী ছবি

এবারের ঈদযাত্রায়ও ভোগান্তির আশঙ্কা করা হচ্ছে। একদিকে ঈদের ছুটি কম থাকা, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে সড়কের অবস্থা ভালো না থাকায় সব সড়ক-মহাসড়কেই ঘরমুখো যাত্রীদের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হবে। উপরন্তু পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু ও মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায় দ্রুততার সঙ্গে টোল আদায় না করতে পারলে দীর্ঘ যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার হার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি হবে এমনটা ধরেই নেয়া যায়। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সড়কে চাপ বাড়বে। এতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের লঞ্চ যাত্রীরা এবার অনেকটাই স্বস্তিতে ঘরে ফিরতে পারবেন।

সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে হলে আগেভাগেই সব মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাসড়কের যেসব স্থানে যানজট হয়ে থাকে সেসব স্থানে যানজট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। লঞ্চ মালিকরা বলছেন, এবারের ঈদে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাত্রা স্বস্তির হবে।

এবারের ঈদযাত্রায় দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা লঞ্চে অনেকটা স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ায় এমনিতেই লঞ্চের যাত্রী কমেছে, বেশির ভাগ যাত্রীই সড়কপথে এই সেতু হয়ে যাতায়াত করবে। তাই লঞ্চ অনেকটাই ফাঁকা থাকবে এবং যাত্রীরা স্বস্তিতেই ঘরে ফিরতে পারবে। তবে যাত্রী কমে গেলেও এবারের ঈদযাত্রায় যাত্রী টানতে আপাতত লঞ্চের ভাড়া কমছে না। ঈদে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করবে লঞ্চগুলো। প্রয়োজনে বিশেষ লঞ্চ সার্ভিসের জন্যও পর্যাপ্তসংখ্যক লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে প্রস্তুত থাকবে। লঞ্চ মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা’ গত শনিবার এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংস্থার সহসভাপতি মো. আবুল কালাম খান বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে লঞ্চে আগের চেয়ে যাত্রী কিছুটা কমবে। কিন্তু তারপরেও ঈদে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করবে লঞ্চগুলো। এই মুহূর্তে লঞ্চের ভাড়া কমানো হবে না। পদ্মা সেতু হয়ে যাত্রীরা তাড়াতাড়ি যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু এই রুটে এখনো পর্যাপ্তসংখ্যক বাস নেই। ভাড়া নিয়েও সমস্যা আছে, লঞ্চের ভাড়া এখনো অনেক কম। এ কারণে লঞ্চেও লোকজন ঈদযাত্রায় শামিল হবে। যাত্রীর চাপের ওপর নির্ভর করে লঞ্চ কোম্পানিগুলো প্রয়োজনে বিশেষ লঞ্চ সার্ভিসের জন্যও পর্যাপ্তসংখ্যক লঞ্চ প্রস্তুত রাখবে। লঞ্চের যাত্রীরা ভিড় এড়িয়ে যাতায়াত করতে পারবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সহযোগী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, পদ্মা সেতু খুলে দেয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা এবার অনেকটাই স্বস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। তবে টোল প্লাজা ও সড়ক ব্যবস্থাপনার ওপর ভোগান্তি বা স্বস্তির বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করবে। একই সঙ্গে তারা সড়ক ও নৌপথের সুবিধা নিতে পারছে। ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রামের যাত্রীদের নির্বিঘœ ঈদযাত্রা টোল প্লাজা ও মহাসড়কের ইন্টারসেকশনগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করবে। দুর্ঘটনা এড়িয়ে ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে হলে মোটরসাইকেল চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সড়কে এখন সবচেয়ে বেশি দুঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের কারণে। তাছাড়া ঈদযাত্রায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে পুলিশ এবং সংশ্লিষ্টদের নজরদারি জোরদার করতে হবে।

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, গত ঈদে দীর্ঘ ছুটি থাকায় মানুষ ধাপে ধাপে বাড়ি ফিরেছে। কিন্তু এবার ঈদের ছুটি কম। তাই লোকজন একযোগে ঈদযাত্রা শুরু করবে। এতে সড়কে চাপ বাড়বে এবং ভোগান্তির সৃষ্টি হবে। এবার বর্ষাকালে ঈদ হওয়ায় আবহাওয়া খারাপ থাকলে সড়ক দুর্ঘটনার হারও বাড়বে। পদ্মা সেতু চালু হলেও সেতুর টোল প্লাজাসহ কয়েক জায়গায় টোল ব্যবস্থাপনা এখনো স্বচ্ছন্দ হয়নি। এবার এই সড়কে অনেক চাপ বাড়বে। তাই পদ্মা সেতু ব্যবহারকারী যানবাহন ও যাত্রীদের যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে। তবে নৌপথে লঞ্চযাত্রায় যাত্রীরা এবার বেশ স্বস্তিতেই ঘরে ফিরতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

এবারের ঈদযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কগুলোতে যানজট ও ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন, কেরানীগঞ্জ থেকে বাবুবাজার হয়ে গুলিস্তান পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের চাপে যানজট লেগেই আছে। এছাড়া ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের বিআরটি প্রকল্পের কারণে যানজট হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাই থেকে সিটি গেট অংশে ভোগান্তি বাড়বে। এই সড়কে ১৭টি কন্টেইনার ডিপো রয়েছে। এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে একই সময়ে দুই ধরনের মুভমেন্ট হবে। যাত্রীবাহী বাস, প্রাইভেটকার ও অন্যান্য যানবাহনের পাশাপাশি কুরবানির পশুবাহী যানবাহনও রাস্তায় নামবে। এতে সড়কের ওপর চাপ বাড়বে।

তিনি আরো বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের দুর্ভোগ কমানো জন্য সরকারকে আগেভাগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যে সড়ক আছে সেটাকেই নির্বিঘœ করতে পুলিশ, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে এখনই পরিকল্পনা করে সড়ক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সব সড়কে ফিটনেসবিহীন বাস যেন চলাচল করতে না পারে, মহাসড়কে নছিমন, করিমনের মতো থ্রিহুইলার চলাচল বন্ধে কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুরবানির ঈদে উত্তরবঙ্গের যাত্রীদের এবার মহাসড়কে ভোগান্তি পোহানোর সম্ভাবনা রয়েছে। পশুর হাটের কারণে গাবতলী থেকে যাত্রীবাহী বাসগুলো বের হওয়ার পথে ভোগান্তি শুরু হবে। এরপর সাভার, আশুলিয়া, চন্দ্রা এলাকায় কুরবানির পশুর হাটের কারণে যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ যানজটের চিত্র নতুন কিছু না। সেতু পার হওয়ার পরে সিরাজগঞ্জ ও বগুড়ার মহাসড়ক উন্নয়নের কাজ এখনো চলছে। বিভিন্ন জায়গায় রাস্তার অবস্থা ভালো না, খানাখন্দ ও গর্ত রয়েছে। বৃষ্টি হলেই যানবাহন চলাচলে অসুবিধার সৃষ্টি হয়, যানবাহনের গতি কমে যায়। তবে এই সড়কের যাত্রী ও চালকদের জন্য সুখবর হচ্ছে যে, ঈদকে সামনে রেখে উত্তরবঙ্গের মানুষের যাতায়াত নির্বিঘœ করতে সিরাজগঞ্জের নবনির্মিত নলকা সেতুর ঢাকামুখী লেনটি খুলে দেয়া হয়েছে। গত রোজার ঈদের আগে এই সেতুর উত্তরবঙ্গমুখী লেনটি খুলে দেয়া হয়। সাসেক-২ প্রকল্পের অধীনে এই ব্রিজটি তৈরি করা হয়। এই লেন উন্মুক্ত করায় উত্তরের ২২ জেলার পুরনো নলকা সেতুর ঢাকাগামী যাত্রায় যে ভোগান্তি হতো তা কেটে যাবে। এছাড়া গাইবান্ধার অনেক এলাকা বন্যাকবলিত হওয়ায় সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলার সড়কও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উত্তরবঙ্গের ঘরমুখো যাত্রীদের পথে পথে ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের ফলে নতুন প্রবেশদ্বার উন্মোচিত হওয়ায় এই অঞ্চলের যাত্রীরা এখন অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। তারা অল্প সময়ে ঘরে পৌঁছার জন্য বাস ও গাড়ি ব্যবহার করবেন। ফলে এই সড়কে ২১ জেলার যানবাহনের চাপ বাড়বে। তাই এই পথেও পদ্মা সেতুর টোল প্লাজাসহ সড়কের বিভিন্ন স্থানে একাধিকবার টোল দিতে যানবাহনগুলো থামতে হবে। এ কারণে এই সড়কেও ভোগান্তি থেকে যাত্রী ও চালকদের মুক্তি নাও মিলতে পারে।

ঝালকাঠী জেলার বাসিন্দা যাত্রী ওয়াদুদ ইসলাম বলেন, গত রোজার ঈদে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম। এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সেই ঝামেলা আর থাকবে না। অর্ধেকের বেশি মানুষ এখন সড়ক পথেই যাতায়াত করবে। এতে অল্প সময়ের মধ্যেই ঘরে ফেরা সম্ভব হবে। তবে ঈদযাত্রা শুরু হলে এক্সপ্রেসওয়ে এবং সেতুর টোল প্লাজায় কী অবস্থার সৃষ্টি হবে, যানবাহনের চাপ কেমন হবে সেটাই ভাবিয়ে তুলছে। তাছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকার পর বরিশাল পর্যন্ত মহাসড়কের অবস্থা ভালো না। সড়ক উন্নয়নের কাজ চলছে। এই দুই জায়গায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেয়া হলে ঈদে ভোগান্তি ছাড়াই যাতায়াত করা সম্ভব হবে।

বাসচালক রায়হান উদ্দিন জানান, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর বেশির ভাগ বাস আগে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া হয়ে যাতায়াত করত। পদ্মা সেতু হওয়ায় এখন ২১ জেলার সিংহভাগ বাস এই সেতু হয়ে যাতায়াত করবে। এ কারণে এবারের ঈদযাত্রায় এই সেতুতে যাবাহনের চাপ বাড়বে। ফলে যমুনা সেতুর মতো পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় দীর্ঘ যানজট হতে পারে। এখানে ঝামেলা না হলে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা স্বস্তিতেই ঘরে ফিরতে পারবেন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা সেতুর টোল প্লাজার ভোগান্তি নতুন কিছু না। এবারো টোল প্লাজায় ভোগান্তির আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের অবস্থা ভালো। তবে ঢাকা থেকে বের হওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, কাঁচপুর, ভুলতা-গাউছিয়াসহ কয়েকটি ব্যস্ত এলাকায় যানজট হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App