×

জাতীয়

গণতদন্ত কমিশনের শ্বেতপত্র : হেফাজতের জঙ্গি কানেকশন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮ মে ২০২২, ০৮:৩৪ এএম

গণতদন্ত কমিশনের শ্বেতপত্র : হেফাজতের জঙ্গি কানেকশন

ছবি: সংগৃহীত

জঙ্গিবাদের অন্যতম প্রধান উৎস হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রম, ওয়াজের মাধ্যমে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানোই এদের অন্যতম কাজ। ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জঙ্গি কর্মসূচি থেকে বিরত ছিল তারা। ওই সময়ে ওয়াজের মাধ্যমে ভিন্নধর্ম ও ভিন্নমত, সংবিধানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে নতুন উদ্যমে মাঠে নামে হেফাজত। এরপর থেকে কখনো সক্রিয়ভাবে, কখনো গোপনে এদের জঙ্গি কার্যক্রম চলছে।

গণতদন্ত কমিশনের শ্বেতপত্রে হেফাজতের ৭৭ নেতার কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। যাদের অনেকেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ-আল-ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত। হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমদ শফী চট্টগ্রামে নেজামে ইসলাম পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন এবং নিজেরাও এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হরকাতুল জিহাদের আদর্শিক গুরু ছিলেন আহমদ শফী। ২০১৩ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রামে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মহাসমাবেশে সুন্নি ওলামায়ে কেরামরা আহমদ শফীকে যুদ্ধাপরাধী দাবি করে তার বিচার চান। হেফাজতের সাবেক আমির জুনায়েদ বাবুনগরী চট্টগ্রামে হরকাতুল জিহাদের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। হুজির মুখপত্র জাগো মুজাহিদ, মাসিক রহমতে নিয়মিত নিবন্ধে যুবসমাজকে উগ্রবাদী হতে উদ্ধুদ্ধ করতেন। তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে আফগান জিহাদে অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের আস্থাভাজন ও মুরুব্বি ছিলেন। আফগান ফেরত জঙ্গি কমান্ডার সগীর বিন ইমদাদের ‘কেন জিহাদ করবো’, ‘জিহাদ কি ও কেন’- জঙ্গি মৌলবাদ গ্রন্থের ভূমিকায় বাবুনগরী লেখেন, ‘নামাজ, রোজার চেয়েও সশস্ত্র জিহাদ অধিক জরুরি। সশস্ত্র জিহাদই হচ্ছে জান্নাত লাভের একমাত্র পথ। অমুসলিম ও স্বৈরাচারী শাসকদের যে কোনো মুহূর্তে যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বাবুনগরী ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর অন্যতম নেতা। চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ের গহিন অরণ্যে ছিল তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

হেফাজতের বর্তমান আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী নেজামে ইসলাম পার্টির একজন নীতিনির্ধারক। ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির নায়েবে আমির। ইসলামী ঐক্যজোটের নায়েবে আমির। হরকাতুল জিহাদের উপদেষ্টা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। একাত্তরে মুজাহিদ বাহিনীর সিনিয়র নেতা ছিলেন। কাপ্তাইয়ের গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের ওয়াজে জঙ্গি উগ্র মতবাদই বেশি। পাকিস্তানের একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা। ২০০৫ সালে তিনি পাকিস্তান যান। সেখানে ৪০ দিন ছিলেন। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতা ঘটান। হেফাজতের উপদেষ্টা সুলতান যওক নদভী হরকাতুল জিহাদের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা।

আফগান সফরের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘রিহলাতি ইলা আরদিল জিহাদ’ (দেখে এলাম জিহাদ ভূমি) বইয়ে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা হওয়া এবং লাদেনের মুখে তার জিহাদি বক্তব্যের প্রশংসা, লাদেনের বাংলাদেশে ফিরে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে অনুরোধ, জিহাদে আল কায়েদা থেকে অস্ত্র, অর্থ দিয়ে সহায়তার কথাও তুলে ধরেন। বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ড ও সশস্ত্র জঙ্গি প্রশিক্ষণ বিষয়ে আত্মজীবনী গ্রন্থ আমার জীবন কথায় তুলে ধরেছেন তিনি।

এদিকে হেফাজতের নায়েবে আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী হরকাতুল জিহাদের উপদেষ্টা। হরকাতুল জিহাদের আফগান ফেরত মুজাহিদদের নিজের মাদ্রাসার ভেতর আস্তানা গড়ার জন্য বিশাল স্থান ছেড়ে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ এক দশক ধরে হরকাতুল জিহাদের প্রচার-প্রকাশনাসহ যাবতীয় কার্যকলাপ আতাউল্লাহ হাফেজ্জীর জামিয়া নূরীয় মাদ্রাসা থেকে চালিয়ে আসছেন। এখনো মাসিক রহমত ও অনলাইন রহমত ২৪ ডটকমের কার্যালয় তার মাদ্রাসায়। হেফাজতের আরেক নায়েবে আমির মাহফুজুল হক হরকাতুল জিহাদের নেতাদের সঙ্গে আফগান-কাশ্মির, পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফর করেন। আফগান ফেরত জঙ্গিরা যখন মোহাম্মদপুর মাদ্রাসায় নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন, তার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে এই হেফাজত নেতার নাম সবার আগে উচ্চারিত হতো। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মুফতি আবদুল হাই, মুফতি আবদুস সালাম, শেখ ফরিদ, ইয়াহইয়া, পলাতক আসামি তাজউদ্দীন ও আব্দুর রউফসহ উচ্চ পর্যায়ের হরকাতুল জিহাদের নেতারা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। জিহাদি আন্দোলন পরিচালনার লক্ষ্যে অর্থ সংগ্রহের জন্য সৌদি আরব, আমেরিকা, কুয়েত, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, লিবিয়া, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন আরেক নায়েবে আমির মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান। রিয়াদ, জেদ্দা, তায়েফ, আল খোবার, করাচি, লাহোর, দিল্লি, বোম্বাই, কলকাতা, ত্রিপোলি, বেনগাজী ও ব্যাংককে অবস্থিত বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করতেন তিনি। সিলেট বিভাগকে জঙ্গিবাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করার প্রধান ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তি হচ্ছেন আইনবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক সাংসদ শাহীনুর পাশা চৌধুরী।

এছাড়া সাবেক মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমী, উপদেষ্টা আব্দুল হালিম বোখারী, নায়েবে আমির নুরুল ইসলাম ওলিপুরী, হাবীবুর রহমান কাসেমী, যুগ্ম মহাসচিব খালেদ সাইফুল্লাহ, যুগ্ম মহাসচিব জুনায়েদ আল হাবিব, অর্থ সম্পাদক আযুব বাবুনগরী, সহ অর্থ সম্পাদক ইলিয়াস হামিদী, সহ প্রচার সম্পাদক শরিফউল্লাহ, কেন্দ্রীয় নেতা শহীদুল ইসলাম, শাহ মমশাদ আহমেদ, নুর হোসাইন নুরানী, সাবেক উপদেষ্টা মুহাম্মদ কাসেম, সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সলিম উল্লাহ, সাবেক নায়েবে আমির তাফাজ্জল হক হবিগঞ্জী, সাবেক নায়েবে আমির মুহাম্মদ তৈয়্যব, সহকারী মহাসচিব আশরাফ আলী নিজামপুরী, নায়েবে আমির সালাহউদ্দীন নানুপুরী, নায়েবে আমির আহমদ উল্লাহ আশরাফ, সাবেক নায়েবে আমির মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, সাবেক নায়েবে আমির প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান, সাবেক নায়েবে আমির মুহাম্মদ ইদ্রিস, নায়েবে আমির মুফতি আহমদ উল্লাহ, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক হেলাল উদ্দীন নানুপুরী বিন জমির, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক হারুন ইজহার চৌধুরী, কেন্দ্রীয় শুরাসদস্য বেলাল উদ্দীন নানুপুরী নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও প্রশিক্ষক।

এ ব্যাপারে গণতদন্ত কমিশনে সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ভোরের কাগজকে বলেন, বেশির ভাগ হেফাজত নেতাই নেজামে পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি, ইসলামী জনকল্যাণ পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার অনেকেই তালেবান ও আল-কায়েদার সঙ্গে আফগান জিহাদে অংশগ্রহণকারী জঙ্গিদের আস্থাভাজন ও মুরুব্বি ছিলেন। হেফাজতের বেশির ভাগ নেতাই মুক্তিযুদ্ধকালে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠনে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করেছেন এবং নিজেরাও এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে হেফাজত। ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা করে। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে ১৩ দফা দাবি করে। ৫মে শাপলা চত্বরে সহিংস সমাবেশ ও তাণ্ডব করে। ওই ঘটনায় ৪৪টি মামলা হয়। ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যে বিরোধিতা করে। তাদের দাবির মুখে ভাস্কর্যটি সরানো হয়। ২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে নতুন উদ্যমে মাঠে নামে হেফাজত। গত বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে তাণ্ডব করে। এতে ১৯ জন প্রাণ হারায় এবং পুলিশসহ ৫ হাজার লোক আহত হন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App