×

জাতীয়

পহেলা বৈশাখ সব সম্প্রদায়ের সর্বজনীন উৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২২, ১০:০৮ পিএম

পহেলা বৈশাখ সব সম্প্রদায়ের সর্বজনীন উৎসব

সনজিদা খাতুন

পহেলা বৈশাখ সব সম্প্রদায়ের সর্বজনীন উৎসব

ফাইল ছবি

ষাটের দশকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের সংস্কৃতির ওপর তো অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছিল- সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে যা বোঝায়- সে সময় তাই ছিল। তারা মুখে কিছু বলত না, যা করার পেছনে করত। তারপরও সামাজিকভাবে, সংগঠনগতভাবে পহেলা বৈশাখ পালিত হতো অনেক আগে থেকেই। বহু জায়গাতেই তা পালিত হতো। এসব নিয়ে আমি তথ্যবহুল একটা লেখা লিখেছি।

আমরা ১৯৬৪ সালে ‘সংগীত বিদ্যায়তন’ শুরু করি। এর উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ পালন করি। ১৯৬৫ সালে তা পালিত হয়নি- বকরি ঈদের জন্য। পরে পালন করেছি। বন্ধুরা বলল, উদয়ন স্কুলের মাঠে। তোমাদের এখানে জায়গা হয় না- তোমরা অন্য কোনো বড় জায়গায় করার চিন্তা করো। তখন চিন্তা করলাম কী করা যায়। ড. নওয়াজেশ আহমেদ ফিলিপিন্স থেকে তখন ফিরে এলেন। তিনি বললেন, চলেন তো দেখি কোথায় একটা জায়গা বের করা যায়। একদিন তিনি রমনা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে আমাদের খাওয়ালেন। রমনার লেকের পাড়ে নিয়ে গেলেন আমাদের। ওখানে বটগাছের নিচে একটা ছোট্ট বেদির মতন আছে। ওখানে অনুষ্ঠান করার কথা ভাবা হয়। ওখানে যে গাছ এখনো আছে- ওটা আসলে বটগাছ না, অশ^ত্থ গাছ। ‘অশ^ত্থ মূল’ বললে কেমন শোনাবে! কেমন যেন গ্রাম-গ্রাম শোনায়- অথচ আমরা অনুষ্ঠান করছি ঢাকায়। আমরা বললাম- বটমূল। ‘বট’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে বিশাল জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গাছ, সেটাই বটগাছ। আমরা ‘বটমূল’ বলেই ঠিক করে নিলাম। অশ^ত্থও বড় জায়গাজুড়ে থাকে। ‘বটমূল’ বললে কি তেমন দোষের হয়! সেই থেকে বটমূল।

‘পঞ্চবটী’ বলে যে-নাম বলা হয়, সেখানেও বিভিন্ন ছায়াবৃক্ষের সমাহার- বেলগাছ, আমলকি গাছ, অশ^ত্থগাছ, বটগাছ- আরেকটি বোধ হয় অশোক গাছ- এই পাঁচটাকে একসঙ্গে পঞ্চবটী বলা হয়। তাহলে ‘বটমূল’ চালু করতে বাধা কোথায় আর! প্রথম বছর দেখি- অনুষ্ঠান চলাকালে ওপর থেকে শুঁয়োপোকা ঝরে ঝরে পড়ছে। গা ফুলে যাচ্ছে। তবুও কাউকে চেঁচামেচি করতে দিতাম না। পরের বছর সবার হাতে একটা করে কাঠি দিয়ে দিলাম। শুঁয়োপোকা গায়ে পড়লে আস্তে করে সরিয়ে ফেলতে পারে যেন। এভাবে চলতে লাগল।

পহেলা বৈশাখে যে গানগুলো হতো- তা ছিল জাগরণের গান। জাগরণ কিন্তু নানা অর্থে। জাতীয় জাগরণ, সাংস্কৃতিক জাগরণ, চেতনাগত জাগরণ- এ রকম চিন্তা করে এগিয়েছি। এটা তো হচ্ছে আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন। এখানে যারা আসত, ভালোবেসে আসত। সেই অনুষ্ঠানে এসে লোকে শুধু গান শুনবে না, পরস্পরের সঙ্গে মিলনের একটা সুযোগও তৈরি হবে। মানুষে মানুষে বন্ধন গড়ে উঠবে। এটা হচ্ছে- জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সবাইকে একত্রিত করার একটা উদ্যোগ ছিল। এটা ছিল বাঙালি জাগরণের উৎসব। সব সম্প্রদায় নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসব। এ রকমভাবে আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকেও বুঝি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরকে বুঝি। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী প্রভৃতি আমাদের ঐক্যের প্রতীক।

[caption id="attachment_344776" align="aligncenter" width="700"] সনজিদা খাতুন[/caption]

২০০১ সালে ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলের অনুষ্ঠানে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানে দুষ্কৃতকারী চক্রের পৈশাচিক বোমা হামলা হয়। অনেকে হতাহত হয়েছে। এটা তো আমাদের সংস্কৃতির ওপর বড় আঘাত। আমি তখনো বলেছি, এখনো বলি- আমরা ধস্ত হয়েছি, ত্রস্ত্র হয়নি। আমরা এখনো ওই সংস্কৃতি চর্চায় রয়ে গেছি। আমরা কখনো সেøাগান দিয়ে, চিৎকার করে ‘সংস্কৃতির জয় হোক’ বলি না। আমরা গঠনমূলক কাজে মনোযোগী হই, গঠনমূলক কাজেই সব সময় লিপ্ত থেকেছি। এ বছর আমাদের কাজ আরো বেড়েছে। এ বছর পহেলা বৈশাখ পালনের ৫০ বর্ষপূর্তি হবে আমাদের।

তবে ২০০১-এর পরে বুঝলাম, সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়ে যে প্রাণের দুয়ার খোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি- তাতে তা যথার্থভাবে হচ্ছে না। আমাদের শিক্ষার দিকে যেতে হচ্ছে। তাই আমরা ‘নালন্দা’ নামে একটা শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-আলাপ পাঠচক্র আছে। আমরা চাই- একটা শিশু ছোটকাল থেকে মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার শিক্ষা পেয়ে বড় হয়ে উঠুক। শিশুকালটা বড় গুরুত্বপূর্ণ সময় মানুষের জীবনে।

ছায়ানটে যারা গান শেখে- পয়সা দিয়ে গান শেখে। একমাত্র গান শেখাটাই বড় কথা নয়। তাদের সংস্কৃতিমনস্ক হতে হবে, মানুষ হওয়ার চিন্তা করতে হবে, পূর্ণ মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তারা তখনই পূর্ণ মানুষ হতে পারবে, যখন নিজের সংস্কৃতিতে তার পূর্ণ অধিকার হবে এবং একে নিয়েই বড় হতে পারবে, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অন্যদের কাছে বড় করে তুলে ধরতে পারবে। অনুলিখন : শরীফা বুলবুল

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App