×

জাতীয়

বাঙালি নারীদের মধ্যে যেভাবে টিপ পরার প্রচলন শুরু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২২, ১০:১০ এএম

বাংলাদেশে একজন নারীকে টিপ পরার কারণে পুলিশের একজন কনস্টেবল হেনস্থা করেছেন, এমন অভিযোগ ওঠার পর ওই পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবারের ওই ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অসংখ্য নারী নিজেদের টিপ পরা ছবি পোস্ট করে হয়রানির নিন্দা জানিয়েছেন।

এমনকি বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সুবর্ণা মোস্তফা ওই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে সংসদে বক্তব্য রেখেছেন। বাংলাদেশ বা বাঙালিদের মধ্যে অথবা দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের মধ্যে টিপ পরা নতুন কিছু নয়। কিন্তু টিপ পরার এই রীতি চালু হলো কীভাবে? খবর বিবিসির।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, হাজার হাজার বছর ধরেই বিশ্বের অনেক দেশের নারীদের মধ্যে টিপ পরার রীতি চালু রয়েছে।

“এটা শুধুমাত্র বাঙালি জাতির বা হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যাপার ছিল না। আঠারো শতকে তো টিপের ব্যবহার খুব সাধারণ হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে তখনকার ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বার্মা, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার নারীরা টিপ ব্যবহার করতেন।” তিনি বলছেন।

তিনি বলছেন, সেই সময় সব ধর্মের নারীদের মধ্যেই টিপ পরার প্রচলন ছিল। তখনকার মুসলমানদের মধ্যেও টিপ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। তার মতে, ইসলামেও টিপ পরা নিষিদ্ধ করা হয়নি। তিনি বলছেন, টিপকে বরাবরই অঙ্গসজ্জার একটি অনুষঙ্গ হিসাবে দেখা হয়েছে। বিশেষ করে অনুষ্ঠানে যাওয়া, বিশেষ সাজগোজ করার সময় টিপকে শেষ উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতো নারীরা। সব ধর্ম, সব শ্রেণির নারীদের মধ্যেই এই রীতি চালু ছিল।

একসময় টিপের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষ বা নারীদের শ্রেণি বা অবস্থান বোঝাতে টিপের ব্যবহার হতো বলে লিখেছেন জিয়াউল হক। ইতিহাসের অলিগলি বইয়ে জিয়াউল হক টিপ প্রসঙ্গে পুরো একটি অধ্যায় লিখেছেন।

“কপালে টিপ বাঙালি তথা আধুনিক বাঙালি নারীর প্রাত্যহিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। স্থান কাল আর পাত্র, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ নারীরা পুরুষের তুলনায় সৌন্দর্য চর্চা করেন বেশি।...বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে কপালে বড় একটি টিপ দেয়া, তার সৌন্দর্য চর্চার অন্যতম এক অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে এটা প্রায় প্রতিটি নারীর জন্যই একরকম বাধ্যতামূলক বিষয় যেন।”

তিনি লিখেছেন, “আমাদের সমাজে এ প্রথাটা এলো কোথা হতে? এর উৎস খুঁজতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়, বাল্মীকি যুগে।” এর বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, এই রীতি চালু হয়েছে প্রায় ৯৫০০ থেকে ১১৫০০ বছর আগে থেকে, যাকে বাল্মীকি যুগ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

সেখানে তিনি লিখেছেন, সেই সময় তৎকালীন হিন্দু সমাজে জাতিভেদ বা শ্রেণিভেদ প্রবল ছিল। “ব্রাহ্মণরা উচ্চ শ্রেণির, তারা ঈশ্বরের অতি নিকটজন, পূত-পবিত্র। পবিত্রতার প্রতীক হিসাবে তারা কপালে সাদা তিলক (চন্দন তিলক) দিতেন। এখনও দেন।”

ক্ষৈত্রিয় হলো যোদ্ধা শ্রেণি, তাদেরকে বীর হিসাবে গণ্য করা হতো। ক্ষিপ্ততা, হিংস্রতা ও সাহসের প্রতীক হিসাবে তারা কপালে লাল টিপ দিতো। বৈশ্যয় শ্রেণির লোকজন হলো ব্যবসায়ী, পেশাই হলো ব্যবসা। এরা কপালে হলুদ রঙের টিপ ব্যবহার করতো।

আর সমাজে সবচেয়ে নিচু লোকজন হলো শূদ্ররা। ....তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল কালো রঙের টিপ। তারা কপালে কালো টিপ ব্যবহার করতে বাধ্য হতো। নারীদের মধ্যেও ভিন্ন মাত্রার শ্রেণিভেদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। শ্রেণিভেদ অনুসারে তাদের বেলাতেও এই টিপ ব্যবহারে একটু ভিন্নতা ছিল।”

তিনি আরও লিখেছেন, সেই সময় যেসব নারীদের মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো, তাদের চিহ্নিত করার জন্যও টিপ দেয়ার রীতি চালু হয়েছিল। আবার উচ্চ বর্ণের বিবাহিত নারীরাও বিয়ের চিহ্নস্বরূপ কপালে সিঁদুরের টিপ পড়তেন।

তবে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলছেন, ''আঠারো বা উনিশ শতকের আগে অনেক সময় টিপ নারীদের শ্রেণি, মর্যাদা ইত্যাদির প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এরপর থেকে টিপ সবার কাছে সাধারণ সৌন্দর্য চর্চার একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে।''

বাঙালি সংস্কৃতিতে টিপের ব্যবহার নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৌমিত্র শেখর দে বলছেন, “টিপকে এখন মানুষ সৌন্দর্য হিসাবে ব্যবহার করে। কিন্তু এই টিপের একটা প্রতীকী ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, ব্যক্তির 'থার্ড আই' হিসাবে এটাকে চিহ্নিত করা হয়। এটা হচ্ছে দূরদৃষ্টি প্রকাশক। এটা সিম্বোলিক হয়ে ধীরে ধীরে টিপ-এ পরিণত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “তৃতীয় চক্ষুর এই ব্যাপারটিকে সমাজ ধীরে ধীরে সৌন্দর্য হিসাবে সমাজ গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। সেটা হয়েছে বহু আগে থেকে। বলা যায়, প্রাচীন, মধ্যযুগ অতিক্রম করে এটা সাম্প্রতিক কালে এসে পৌঁছেছে।”

এই বিষয়ে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ইসলামিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মুখতার আহমেদ বলেন, টিপ নিয়ে যে বিতর্কটি আমরা দেখছি, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। শরীয়া দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলমান নারী টিপ পরতে পারবেন কি পারবেন না, এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা কোরান বা হাদিসে নেই।

“একজন নারী তার সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য অবশ্যই বিভিন্ন ধরণের অলংকার পরতে পারবেন। টিপও তার অলংকরণ বা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য একটি উপকরণ হিসাবে তিনি ব্যবহার করতে পারবেন। টিপ পরা নিষিদ্ধ, এরকম কোনো বক্তব্য কোরান বা হাদিসে নেই।”

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর দে বলেছেন, ''টিপের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আবহমান কাল থেকে বাঙালিদের মধ্যে ছিল না। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষ বাঙালিরা টিপ ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য চর্চার ইতিহাসের সঙ্গে টিপের বিবর্তন যুক্ত, বাঙালির জন্য অন্তত ধর্ম-বর্ণের কোনো সম্পর্ক নেই।”

তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ইসলামিক শিক্ষার অধ্যাপক মুখতার আহমেদ। তিনি বলছেন, “তবে ইসলামের শরীয়া বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, একজন মুসলিম নারী নিজস্ব অঙ্গনে, ঘরের মধ্যে, মাহরাম পুরুষদের (যে পুরুষদের সামনে দেখা দেয়া বাধা নেই) তাদের সামনে বা নারীদের সামনে পরতে পারবেন। কিন্তু এটা যেহেতু একটা সৌন্দর্যের ইস্যু, তিনি অন্য কোনো পুরুষের সামনে ডিসপ্লে করতে পারবেন না।”

তবে ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক দিক থেকে দেখতে গেলে টিপকে এই অঞ্চলে হিন্দু বিবাহিত ধর্মাবলম্বীদের একটি অলংকরণ হিসাবে অনেকে দেখে থাকেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। ফলে, তিনি মনে করেন, টিপ পুরোপুরি বাঙালি কালচারের অংশ তা নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App