×

জাতীয়

বৃহৎ শিল্প থেকে ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে সরকার!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২, ০৮:২০ এএম

বৃহৎ শিল্প থেকে ভর্তুকি তুলে নিচ্ছে সরকার!

প্রতীকী ছবি

দেশের সব বড় প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়া থেকে সরে আসার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অব্যাহতভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকির চাপ সামলাতে দাম বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দুই খাতে ভর্তুকি কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর সংশ্লিষ্টরা ভর্তুকি কমানোর কৌশল খুঁজতে তৎপরতা শুরু করেছে।

তবে দাম বাড়িয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের কৌশলের বিরোধিতা করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন’ বাতিল করা, অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমালে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও ভর্তুকি কমানো খুবই সম্ভব। ভর্তুকি কমাতে শুধু দাম বাড়ালেই সমস্যার সমাধান হবে না। একই সঙ্গে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। কর্তৃপক্ষের বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে যে দাম বাড়ে- সেসব জায়গায়ও হাত দিতে হবে। ভোক্তার প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাপ্যতা এবং দেয়ার ক্ষমতা অনুযায়ী ভর্তুকি দিতে হবে।

সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় বেশ চড়া মূল্যে জ্বালানি আমদানি করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। এটা কোনো সঠিক পরিকল্পনা নয় বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। সরকারকে ভর্তুকির খাতগুলোকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কিন্তু এই পর্যালোচনার বিষয়টি সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাই দফায় দফায় দাম বাড়ানোর মাধ্যমেই গ্যাস ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দেয় ৪ হাজার কোটি টাকা। এই বরাদ্দ দিয়ে ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়। এলএনজি আমদানি করতে ১৬০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। সেজন্য গত নভেম্বরে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। একদিকে আমদানি করা গ্যাসের দাম বেশি, অন্যদিকে এ খাতে ভর্তুকি কম। এই দুই বিষয়কে সামনে রেখেই জ্বালানির দাম বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

সূত্র জানিয়েছে, গ্যাস থেকে দেশের ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বাকি প্রায় ৩০ ভাগই উৎপাদন হয় তেল থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অল্প কিছু বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে পাইকারি বিদ্যুৎ কিনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ মোট ৬টি কোম্পানির মাধ্যমে বিতরণ করে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এই বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে। এখন যদি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং বিদ্যুতের দামও বাড়াতে হবে। ভর্তুকি কমাতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হলেও মূল সমস্যার সমাধান হবে না। সব ক্ষেত্রে দ্রব্যমূল্য বাড়বে। জনগণের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে।

এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে ঠেকেছে, জনগণকেই বাড়তি চাপ সামলাতে হচ্ছে। তারপরও আমি বলব গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো খুবই সম্ভব। অযৌক্তিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ভর্তুকি বাড়ছে। অগ্রহণযোগ্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ভর্তুকি বেড়েছে। এসব অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য ব্যয় কমাতে হলে সবার আগে এবং দ্রুত ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন’ বাতিল করতে হবে। এছাড়া সর্বস্তরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডমূলক টেন্ডার এবং সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডারের ভিত্তিতে, উন্মুক্ত টেন্ডারের ভিত্তিতে কাজকর্ম করতে হবে। বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। কারণ মরা প্রাণীর কারণে কোনো কূপের পানি দূষিত হলে আগে ওই প্রাণীকে তুলে ফেলতে হবে। তারপরে দূষিত পানি বদলাতে হবে। ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন’ রেখে দিয়ে যদি বলেন মূল্য কমাতে হবে, ভর্তুকি কমাতে হবে- তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না।

এম শামসুল আলম আরো বলেন, ভর্তুকি কমানোর মানে হচ্ছে ঘাটতি কমানো। এখন ঘাটতি কমাতে যদি দাম বাড়ানোর ওপর নির্ভর করেন, তাহলে সেটা পৃথিবীর দিগন্ত রেখার মতো দেখা যাবে কিন্তু ধরা যাবে না। কারণ অযৌক্তিক ব্যয় ও দুর্নীতি যে সমস্যার সৃষ্টি করছে; সেই কারণে ব্যয় বেড়েই চলছে। প্রকৃত ও প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তুলনায় বেশি অর্থ খরচ হচ্ছে। অর্থ তছরুপ হচ্ছে। তাই সরকারকেও ভর্তুকি দিতে দিতে জনগণের ঘাড়ে চাপাতে হচ্ছে। বাড়তি অর্থ দেয়ার বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই বাড়তি চাপ হয়ে যাবে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, ভর্তুকি কমাতে এখন যদি গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। সব জিনিসের দাম কয়েকগুণ বাড়বে। কোনো ক্ষেত্রেই দাম এক জায়গায় থেমে থাকবে না, সার্বিক পারিপার্শ্বিকতার কারণেই দাম বাড়বে। ভর্তুকি কমাতে দাম বাড়ানো মূল সমস্যার কোনো সমাধান নয়। এটা করা হলে মানুষের জন্য শাস্তিস্বরূপ হবে। করোনার কারণে এখন দুঃসময় যাচ্ছে। মানুষ আরো বেশি দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এখন যেটা করা যেতে পারে তা হলো- গ্যাসের চুরি বন্ধ করা, অপচয় বন্ধ করা, সব ধরনের সিস্টেম লস বন্ধ করতে হবে। এগুলো বন্ধ করার উপায় আছে। কিন্তু দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হবে অন্যায্য উপায়। সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানো। এটা করাই হবে সমস্যার মূল সমাধান। এখনো অল্প পরিমাণে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে, তাতেই আমরা অনেক গ্যাস পাই। আরো বেশি পরিমাণ উৎপাদন হলে সহজলভ্যতা বাড়বে এবং ভর্তুকি কমবে। কারণ বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানি কমবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, দ্রুত চুরি-অপচয় বন্ধ করে গ্যাস অনুসন্ধানের দিকে নজর দিতে হবে। তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের যে ব্যয় রয়েছে সে অনুযায়ী যেহেতু আয় বাড়েনি, সেহেতু আর্থিক চাপ তো রয়েছেই। আমরা যা আমদানি করছি বা উৎপাদন খরচ হচ্ছে সেগুলোর সঙ্গে যে মূল্য আছে সেটার পার্থক্য হচ্ছে এবং আমাদের বাজেটের ওপর চাপ বাড়ছে- এটা হলো বাস্তবতা। তাই ভর্তুকি আমাদের কমাতে হবে। ভর্তুকি সামাল দেয়ার একটি উপায় হচ্ছে সরকার যে সেবাটা দিচ্ছে তার দাম বাড়িয়ে ভোক্তার কাছ থেকে আদায় করা। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে যে করোনার এই সময়ে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাও কমেছে। তারা কতটুকু ভার বহন করতে পারবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। অন্যদিকে বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে যে মূল্যটা বাড়ে সেসব জায়গাতেও আমাদের হাত দিতে হবে। জ্বালানির ক্ষেত্রে বিপুল উৎপাদন হয়েছে কিন্তু সরবরাহ করা যায়নি। অথচ এই খাতে বসিয়ে বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ দিতে হয়েছে বেসরকারি পাওয়ার কোম্পানিগুলোকে (আইপিপি)। তেলের ওপর ৩০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আছে, এই খাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে, দুর্নীতি আছে। এসবের কারণে এই সেবা খাতের ব্যয় বাড়ে। তাই এসব জায়গাতে হাত দিতে হবে। শুধু যদি ভোক্তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তাদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর চাপ পড়বে। নিম্ন আয়ের, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং স্থির আয়ের মানুষের ওপর চাপটা পড়বে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান আরো বলেন, ক্ষেত্র বিশেষে দামের তারতম্য এখনো আছে। পিক আওয়ার, অফপিক আওয়ারসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির সুবিধাগুলোর ব্যবহার করতে হবে। দামের সমন্বয় নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য যেন অসহনীয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তা না হলে অর্থনৈতিকভাবে হয়তো সিদ্ধান্ত লাভজনক হতে পারে; কিন্তু রাজনৈতিক বা নৈতিক- এই দুইদিক থেকেই সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। শুল্ক সমন্বয় করে, অব্যবস্থাপনা দূর করে, দুর্নীতি দমন করে, নীতিমালার মধ্যে বৈষম্য দূর করে, কতটা চাপ কমানো যায়, মানুষের সক্ষমতা ও আয় অনুযায়ী ভর্তুকি সমন্বয় করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাপ্যতা এবং দেয়ার ক্ষমতা অনুযায়ী ভর্তুকি দিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App