×

জাতীয়

খুন-খারাবি বেড়েছে, ছিনতাইও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২২, ০৮:৩২ এএম

খুন-খারাবি বেড়েছে, ছিনতাইও

প্রতীকী ছবি

হঠাৎ করে রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবনতি ঘটেছে। এমনিতে প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন কিছু অঘটন ঘটলেও গত এক সপ্তাহের অবনতিশীল পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও ভাবনায় ফেলেছে। খুনের চেয়ে বেশি ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। রাতের রাস্তায় ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে মানুষ। বাধা দিলে রক্তাক্ত এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। আইনি ঝামেলা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ করেন না ভুক্তভোগীরা। ফলে পুলিশের রেকর্ডে অপরাধের যে পরিসংখ্যান রয়েছে, বাস্তব চিত্র তার চেয়েও ভয়াবহ।

এ প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, হঠাৎ করে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা অন্যতম একটি কারণ। যদিও ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে সহিংস অপরাধ রেখার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। এটাকে আমরা সিজনাল ভেরিয়েশন ইন ক্রাইম বলে থাকি। গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চ-জুন মাসে আমাদের দেশে সহিংস অপরাধ রেখা ঊর্ধ্বমুখী থাকে।

তিনি আরো বলেন, কোনো অপরাধ ঘটার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুরুত্ব দেয়। তবে তা যেন ঘটতেই না পারে, সেদিকে তেমন তৎপর দেখা যায় না পুলিশ বাহিনীকে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রতিরোধে বেশি নজর দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। এ কাজে সাধারণ জনগণসহ সমাজের সব স্তরের মানুষকেও সম্পৃক্ত করতে হবে।

এদিকে ডিএমপি কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, ব্যস্ত নগরীতে ছিনতাই পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। খুন-চুরি-ছিনতাই রোধে সবাই সচেতন হবে। তাহলে এসব অপরাধ কমে আসবে হয়তো। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, খুন, চুরি, ছিনতাই প্রতিরোধে গোয়েন্দা পুলিশের প্রায় ৭০টি টিম পুরো ঢাকা মহানগরীতে দায়িত্ব পালন করছে। এর মধ্যেও কিছু ঘটনা ঘটছে যার একটার সঙ্গে আরেকটার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে বেশির ভাগ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কয়েকটি ঘটনায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করতে পারব। পুলিশের দাবি, খুন-চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও তা এখনো ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেনি। অধিকাংশ ঘটনায় আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি দুয়েকটি ঘটনায় তদন্তের কাজ অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের ডিসি ওমর ফারুক হোসেন বলেছেন, কে কাকে হত্যা করবে, সেটি মনোজগতের বিষয়। ডাকাতি, ছিনতাই কিংবা চুরি বেড়ে গেলেই কেবল আইনশৃঙ্খলার অবনতি বলা যেতে পারে। অপরাধের মাত্রা কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। আশা করা যাচ্ছে, সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সব কিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না।

ওমর ফারুক আরো বলেন, পুলিশ ট্র্যাডিশনাল দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। তারা এটাকে মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ মনে করে। যার কারণে একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীতে চিকিৎসক নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিনতাই নয়। এটি তার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে। কারণ তিনি কিছুদিন আগে ১৫ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন। পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়।

এদিকে শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা এবং এক ছাত্রীকে গুলি করে হত্যাসহ পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, নার্স, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ মিলিয়ে ১৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এছাড়া ছিনতাইকারীদের হাতে ছয় পুলিশ সদস্য জখম হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ২৪ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় ফেরার পথে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। তার গাড়িচালক মুন্না এ সময় গুলিবিদ্ধ হন। টিপুর গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতি সে সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। শনিবার রাজধানীর সবুজবাগের একটি বাসায় দুই শিশুসন্তানের মুখ বেঁধে রেখে তাদের মা মুক্তা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রবিবার ভোরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহী বুলবুল। এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি নিহতের স্বজনদের। নিহত বুলবুল চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজ করতেন। ঠিকাদারির একটি কাজে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। এছাড়া দুই দিনে গুলিস্তান ও বংশালে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন পুলিশের ছয় সদস্য।

উত্তরায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় টাকাভর্তি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডে রবিবার দুপুর আড়াইটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে রিপন দাশ নামের একজন উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগ থেকে জানা যায়, উত্তরার গরীবে নেওয়াজ রোডের ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড থেকে দুটি চেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা তোলেন রিপন দাস ও রাসেল দে। পরে তারা রিকশায় উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের সাইনিং অ্যাসোসিয়েট অফিসের কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই এ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

অভিযোগকারী রিপন দাস জানান, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যাগে নিয়ে রিকশায় অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন তারা। অফিসের কাছে ইউটার্ন নেয়ার সময় রিকশা স্লো করা হয়। তখন পেছন দিক থেকে একটি মোটরসাইকেলে দুজন এসে তাদের কাছ থেকে টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ছিনতাইকারীরা মুখে মাস্ক, কালো রঙের পোশাক পরা ছিল।

উত্তরা জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার এস এম আশিকুর রহমান বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর পরই সিসি টিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কারা ঘটিয়েছে শনাক্তের চেষ্টা চলছে।

রাজধানীর উত্তরা, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। এর একটি চক্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হলে তাদের দেয়া তথ্য তদন্ত করছেন গোয়েন্দারা। মোহাম্মদপুরেই ভিন্ন কায়দায় দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের শিকার হন এক যুবক। আহত হওয়ার পর কয়েক দিন হাসপাতালেও থাকতে হয়েছে। ঘটনায় জড়িতরা আটক হয়েছে।

ভুক্তভোগী মো. রুমান খান জানান, ছিনতাইকারীরা তার কাছ থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিতে গেলে তিনি বাধা দেন। তখন চাপাতি দিয়ে তার হাত ও মাথায় আঘাত করা হয়। গত মাসে কারওয়ান বাজারে বাংলাভিশনের অফিস ভবনের উল্টো দিকে ছিনতায়ের শিকার হন আনিসুর রহমান। তার কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নেয়া হয়। এরপর আনিসকে ছুরি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয় ছিনতাইকরীরা। পরে পুলিশ তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যায়। উত্তরার সানজিদা রাফসান জনি নামে এক নারী ভুক্তভোগী জানান, ছিনতাইকারী তার হাতের ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে গেলে তার হাতে আটকে যায়। তখন সেই ছিনতাইকারীদের প্রাইভেটকারটি তাকে টেনে হিঁচড়ে কয়েকশ মিটার দূরে নিয়ে যায়।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা মহানগরীতে ১৪৫টি, ২০২০ সালে ১৭৬টি, ২০১৯ সালে ১৫৫টি, ২০১৮ সালে ২১৬টি, ২০১৭ সালে ১০৩টি, ২০১৬ সালে ১৩২টি, ২০১৫ সালে ২০৫টি ও ২০১৪ সালে ২৬৫টি মামলা দায়ের হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে ১০টি।

ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত রাজধানী ঢাকায় সুযোগ পেলেই ছিনতাইকারী চক্র জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত নগরীতে ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনা ঘটে। পথে পথে ওত পেতে থাকা ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা দিনে-দুপুরেও ছিনতাই করে। গত মাসে রাজধানীর মিরপুর বাউনিয়াবাঁধ ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে রায়হান (২৫) নামে এক পোশাককর্মী নিহত হন। তার মরদেহ ঢামেক হাসপাতাল মর্গে নেয়া হয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানা পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। মোশারফ হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী রাজধানীর শ্যামবাজারে মালামাল কিনতে যাচ্ছিলেন। সায়েদাবাদ ফ্লাইওভার ঢাল থেকে দয়াগঞ্জের দিকে যাওয়ার সময় সড়কে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তিনি। তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে ঢামেকে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই রাতেই যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ মোশারফের হত্যাকারী দুই ছিনতাইকারী সজীব (২০) ও শাকিলকে (২০) গ্রেপ্তার করে। তারা এর আগেও যাত্রাবাড়ীতে একটি ছিনতাইয়ে হত্যা মামলার আসামি ছিল। মো. জাহাঙ্গীর হোসেন নামে একজন ভুক্তভোগী বলেন, মিরপুর থেকে সূত্রাপুরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এই বিশাল দূরত্বে কোনো টহল পুলিশ না দেখতে পেয়ে অনেকটা ভয় পেয়েছিলেন তিনি। সূত্রাপুরে দুজন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেল থামিয়ে ফোন ও মানিব্যাগে থাকা টাকা নিয়ে চলে যায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App