×

জাতীয়

কন্যার চোখে পিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২২, ১০:০৬ পিএম

কন্যার চোখে পিতা

বড় মেয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে, বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে, বাবুই পাখির বাসার খোঁজে, মাছরাঙার ডুব দিয়ে মাছ ধরা দেখে, দোয়েল পাখির বাসার খোঁজে ছুটে বেড়াতেন যে শিশু, নিজের খাবার অকাতরে তুলে দিতেন অনাহারির মুখে, বর্ণিল শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে তিনি পরিণত হলেন পুরো বঙ্গের বন্ধুতে। টুঙ্গিপাড়ার মিয়া ভাই থেকে বাংলার মুজিব ভাই হিসেবে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার পর অনন্য উচ্চতায় আসীন হলেন। পরিণত হলেন বাঙালির জাতির পিতায়। অজস্র গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সিনেমায় বঙ্গবন্ধুর স্তুতি তুলে ধরছেন কবি-সাহিত্যিকরা। তাকে নিয়ে গবেষণা হচ্ছে দেশে-বিদেশে। গত ৫০ বছরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পিএইচডি করেছেন ৫২ জন। এর মধ্যে ৪৫টি গবেষণা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট থেকে হয়েছে। আর বাকিগুলো দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলেবেলা কেমন ছিল, ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে তার একটি চিত্র এঁকেছেন মুজিবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছয় ফুট বাই দ্ইু ফুটের বিশাল বপু, কালো কোট, কালো ফ্রেমের সিংহ হৃদয়ের মানুষটি শৈশবে ছিলেন বেশ রোগাপটকা। পছন্দ ছিল সাধারণ বাঙালি খাবার। কন্যা শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আমার আব্বার শরীর ছিল বেশ রোগা। তাই আমার দাদি সবসময়ই ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তার খোকার শরীর ভালো করা যায়। আদর করে দাদা-দাদিও খোকা বলেই ডাকতেন। আর ভাইবোন গ্রামবাসীদের কাছে পরিচিত ছিলেন মিয়া ভাই বলে। গ্রামের সহজ সরল মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে তিনি মিশতেন। আমার দাদি সবসময় ব্যস্ত থাকতেন খোকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হতো। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সব সময় খোকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু আমার আব্বা ছোট্টবেলা থেকে ছিপছিপে পাতলা ছিলেন। তাই দাদির আফসোসের সীমা ছিল না- কেন তার খোকা একটু হৃষ্টপুষ্ট-নাদুসনুদুস হয় না? খাবার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝোল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ ভাত কলা ও গুড় খুব পছন্দ করতেন।’

লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল কিশোর শেখ মুজিবের। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতি নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লারহাট যেতেন খেলতে। গোপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে, তোমার আব্বা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়ত। আব্বা যদি ধারেকাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম।’

শিশুবেলা থেকেই অন্যের কষ্ট লাঘবের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল শেখ মুজিবের। শেখ হাসিনা বর্ণনা করেছেন, ‘দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হতো তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে -দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শতছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।’ মানুষের জন্য যিনি একদিন প্রাণ উৎসর্গ করবেন, তিনি যে দরিদ্র বালককে গায়ের জামা দিয়ে দেবেন, এটিই স্বাভাবিক।

কৈশোরেই খুব বেশি অধিকার সচেতন ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। একবার যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা গোপালগঞ্জ সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশোর মুজিব তার কাছে স্কুলঘরে বর্ষার পানি পড়ার অভিযোগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। শেখ হাসিনা লিখেছেন ‘... এই সময়ে তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে। এই সময় থেকে তার রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়।’

১৯৪৬ সালে বিএ পাস করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান-ভারত ভাগ হওয়ার সময়ে যখন দাঙ্গা হয়, তখন দাঙ্গা দমনে সক্রিয় ভ‚মিকা রাখেন। কাজ করে যেতেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। শেখ হাসিনার ভাষায়, ‘অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বাবার মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ, যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে আমার দাদা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন। আমার মেজ ফুপু তখন কলকাতায় থাকতেন। ফুপুর কাছে শুনেছি, মাঝে মাঝে অভুক্ত অবস্থায় হয়তো দুই দিন বা তিন দিন কাজ করে গেছেন। মাঝে মাঝে যখন ফুপুর খোঁজখবর নিতে যেতেন তখন ফুপু জোর করে কিছু খাইয়ে দিতেন। অন্যায়কে তিনি কোনো দিনই প্রশ্রয় দিতেন না। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনো পিছপা হননি। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশ নেন। সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। অল্প কয়েক দিন পর মুক্তি পান। এই সময় পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার কথা ঘোষণা দেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দিলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি বাঙালি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ছাত্রসমাজ এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়। এই আন্দোলনে ১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেপ্তার হন। আমি তখন খুব ছোটো, আর আমার ছোট ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযোগ পাননি। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন।’

ছোট ভাই শেখ কামালসহ পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেদনাময় মধুর স্মৃতিচারণ করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার ভাষায়, ‘সেই সময় আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনো দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বারবার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি, আব্বা-আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গোপালগঞ্জ থানায় একটি বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খেলার মাঠ। ঐ মাঠে আমরা দুই ভাইবোন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল-পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না। আজ ও নেই। আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই।’

আজ শতবর্ষ পর এমন এক সময়ে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে যখন টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আজ বঙ্গবন্ধুর চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে আজ এমন শপথ নেবে পুরো জাতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App