×

জাতীয়

শূন্য থেকে মহাশূন্যে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ মার্চ ২০২২, ০৮:২১ এএম

শূন্য থেকে মহাশূন্যে

ফাইল ছবি

চারিদিকে শুধু মৃত্যুর আহাজারি। বিধ্বস্ত অবকাঠামো। নেই সড়ক, রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও। ব্রিজগুলো প্রায় সবই ধ্বংস, গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পোড়ামাটির অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা মাত্র এক টাকা। ধ্বংসস্তূপে ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি। অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই। সেই শূন্য থেকেই যাত্রা শুরু। ফিনিক্স পাখির মতোই আগুনডানায় ভর করে শূন্য থেকে মহাশূন্যে পঞ্চাশ বছরের লাল-সবুজের বাংলাদেশ। সাবমেরিন কেবল থেকে মহাবিশ্বের গর্বিত মালিক। দারিদ্র্যের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল। খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য রপ্তানির দেশ। পঞ্চাশ বছরের চড়াই-উৎরাইয়ে উন্নয়নের মহাসড়কে। চ্যালেঞ্জ পাহাড়সম, তবুও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। রূপকল্প-২০৪১ এর আগেই উন্নত দেশের স্বপ্ন দেখছে জাতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে (৭৩-৭৪) দেশের জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এই জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ। বর্তমানে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৯১ ডলার। গত পাঁচ দশকের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের সামাজিক অর্জনও চোখে পড়ার মতো। মানুষের গড় আয়ু ৪৭ থেকে বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৭২ দশমিক ৮ বছর। নারী শিক্ষার অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। ‘অ্যানুয়াল রিপোর্ট অন পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ফর দ্য ইয়ার ১৯৭০-৭১’ প্রতিবেদন বলছে, দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২৮ শতাংশ ছিল ছাত্রী।

বর্তমানে প্রাথমিকে নারী শিক্ষার হার ৫১ শতাংশ। কৃষিতেও বাংলাদেশের অগ্রগতি অনেক। বিবিএসের তথ্যানুসারে, চাল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ বাংলাদেশ। সব ধরনের খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে ১১তম, মোট ফল উৎপাদনে ২৮তম, আম উৎপাদনে সপ্তম এবং চা উৎপাদনে দশম। আর মাছে-ভাতে বাঙালির এই দেশ মাছ উৎপাদনে তৃতীয়। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। দারিদ্র্য হ্রাস, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চিহ্নিত, বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতি,

উদ্যোক্তা শ্রেণির বিকাশ, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানো, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, শিল্প খাতের বিকাশ, কৃষিতে বহুমুখীকরণ, মৎস্যে রূপালি বিপ্লব, পশুসম্পদের উন্নয়নের ফলস্বরূপ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর বাংলাদেশের বড় অর্জন। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। গত ৫০ বছরে সম্পদ ও ভোগে বৈষম্য বেড়েছে, শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, সামাজিক খাতে দুর্নীতির বিস্তার লাভ, পরিবেশ বিপর্যয় মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে।

সর্বত্র ডিজিটাল ছোঁয়া : ডিজিটাল ছোঁয়ায় বদলে গেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে একীভূত নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে ১৮ হাজার ৪৩৪ সরকারি অফিস। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৪৪টি কম্পিউটার ল্যাব এবং ১০০ স্মার্ট ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি, যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, ঢাকার জনতা টাওয়ার সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ছাড়াও রাজশাহী, সিলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কসহ ১২টি জেলায় আইটি পার্ক নির্মাণের কাজ চলছে। বান্দরবানের লামা-থানচি, রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালি, হাতিয়ার স›দ্বীপ, বাগেরহাটের দুবলার চর, ভোলার চর কুকড়িমুকড়ি, পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালি, কুড়িগ্রামের ছিটমহল, তিস্তার চরসহ দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় ৭৭২টি ইউনিয়নে ইন্টারনেট সংযোগে কাজ করছে কানেক্টেড বাংলাদেশ প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথের আওতায় এসেছে ৩১ দ্বীপ।

সাবমেরিন ক্যাবলে কারিগরি ত্রুটি বা দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে জরুরি মুহূর্তে ইন্টারনেট সেবা দেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ২০০৮ সালের ৫০ হাজারেরও কম কর্মসংস্থান ১৩ বছরে ১৫ লাখের বেশিতে এসেছে; ২০০৮ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল মাত্র ৫৬ লাখ, তা এখন প্রায় ১২ কোটি; সরকারি ওয়েবসাইট ছিল মাত্র ৫০টিরও কম আর ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তথ্য বাতায়ন বাংলাদেশের, যেখানে সরকারি ওয়েবসাইট ৫২ হাজার; ২০০৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বাজার ছিল ২৬ মিলিয়ন, ২০২১ সালে তা এখন ১ বিলিয়ন ডলার। দেশের ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) থেকে গ্রামীণ জনপদের মানুষ খুব সহজেই তথ্য ও প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন প্রসঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর জোহা ভোরের কাগজকে বলেন, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব বড় অর্জন। তৃণমূল পর্যায়ে স্কুলগুলোতে কানেক্টিভিটি তৈরি, থানা পর্যায়ে থ্রিজি, ফোরজি চালু বড় সফলতা। বাইরের বিনিযোগকারীদের জন্যও ডিজিটাল বাংলাদেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। নারী-শিশুদের জন্য ঝুঁকি কমাতে হবে। ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে এনালগ আক্রমণ কমাতে হবে।

চ্যালেঞ্জ বহুমুখী : বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্চাশ বছর পরও লড়তে হচ্ছে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। একদিকে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে নেয়ার কঠিন শপথ, অন্যদিকে উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর বাংলাদেশের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ অসা¤প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র চেয়েছিলেন; কিন্তু গত ৫০ বছরে এই বৈষম্য আরো বেড়েছে। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা, আরেকটি সমাজতন্ত্র- এই দুই নীতিকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতিটি পালিয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বাড়ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল আকাক্সক্ষা ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। উন্নয়ন কেবলমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও আগামী দিনের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App