×

জাতীয়

জলবায়ু তহবিল সংগ্রহই প্রধান চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:৩৬ এএম

জলবায়ু তহবিল সংগ্রহই প্রধান চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগ কমাতে তহবিল আসবে মূলত ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবি, ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে তাদের জন্য ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল করতে হবে। এর সিংহভাগই খরচ হবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। তবে এই তহবিল সংগ্রহ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে উন্নত-ধনী দেশগুলোর অনীহার পাশাপাশি জবাবদিহিতামূলক পরিকল্পনাকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

পৃথিবীর বাতাসে যত কার্বন-ডাই অক্সাইড মিশছে, তার অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি দেশ থেকে- চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। কপ-২৬ সম্মেলনেও তারা বলেছে, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। পরিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক।

অন্যদিকে জলবায়ু তহবিল সংগ্রহ নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছে অনুন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলো। এসব দেশের কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঝড়-বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ তৈরি, আর খরা-বন্যা-ভাঙন-লবণাক্ততায় বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন।

দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোর দাবি তোলা হচ্ছে, কমপক্ষে তহবিলের ৫০ শতাংশ এমন সব প্রকল্পে দিতে হবে, যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষজনকে বাঁচাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তাদের সাহায্য করবে।

এক্ষেত্রে তহবিল সংগ্রহে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার পাশাপাশি সুপরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জানতে চাইলে পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ভোরের কাগজকে বলেন, তহবিল সংগ্রহে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। প্রকল্প ডিজাইন থাকতে হবে। জবাবদিহিতামূলক পরিকল্পনা প্রয়োজন। কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে এর জন্য পরিকল্পনা অবশ্যই প্রয়োজন।

তহবিল সংগ্রহে প্রয়োজন আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব : সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ সম্মেলনে অংশ নেয়া ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর প্রধান দাবি মেনে ২০১৯ সালের পর্যায় থেকে জলবায়ু অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন ২০২৫ সালের মধ্যে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু তহবিল দেয়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি ধনী দেশগুলো।

আগামী বছর জাতিসংঘ কমিটির এ অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন দেয়া উচিত। জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে ২০২২, ২০২৪ ও ২০২৬ সালে সরকারগুলোর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিয়েছে যুক্তরাজ্য। আর জাতিসংঘ বলছে, বছরে ওই ১০০ কোটি ডলারও গরিব দেশগুলোর প্রকৃত চাহিদার চেয়ে অনেক কম। কারণ শুধু অভিযোজনের ব্যয় হিসাব করলেই ২০৩০ সাল নাগাদ ৩০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে ক্ষতির পরিমাণ।

বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য তহবিল ও প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারত্বকে সহায়তার জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণের দায় খুবই নগণ্য; অথচ বিশ্বের এই দূষণ পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে জি-২০ভুক্ত অধিকাংশ দেশ।

বার্ষিক জলবায়ু মোকাবিলা তহবিলের জন্য প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহের লক্ষ্যে এ বছর বিশ্ব সম্প্রদায়কে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, তহবিল সংগ্রহ অবশ্যই সম্ভব। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্ভব। ইতোমধ্যে ৭০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ হয়েছে। এক বছরের মধ্যে বাকিটা হয়ে যাবে বলে আশাবাদী তিনি।

জলবায়ু তহবিল গঠনে চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব ভোরের কাগজকে বলেন, অভিযোজন বড় চ্যালেঞ্জ। রয়েছে প্রযুক্তি চ্যালেঞ্জ। অর্থ ও কারিগরি চ্যালেঞ্জ। একা সামাল দেয়া অসম্ভব। বিরাট অংশ বিনিয়োগ করতে হবে। অভিযোজনে মানুষকে প্রস্তুতি করতে, সক্ষম করতে বিনিয়োগ প্রয়োজন। যারা অন্যায় করছে, তারা দায় নিচ্ছে না।

তারা কার্বন নিঃসরণ কমাবেও না, আবার টাকাও দেবে না। আমাদের বিকল্প চিন্তা করতে হবে। সবাই মিলে আওয়াজ তুলতে হবে। পরিকল্পিতভাবে আত্মনির্ভরশীলতার কথা ভাবতে হবে। ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়ে সংশয় রয়েছে।

কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা : মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ দশমিক ৫, জাপানের ৯ দশমিক ৫, মালয়েশিয়ার ৭ দশমিক ৭, ভারতের শূন্য দশমিক ৮ টনের বিপরীতে বাংলাদেশের নিঃসরণ মাত্র শূন্য দশমিক ৩ টন। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ক্ষতিকর প্রভাবও বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি।

ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) চতুর্থ সমীক্ষা অনুসারে, গত শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৭৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ যা ২ দশমিক ৫০ থেকে ৩ দশমিক ৫০ সেলসিয়াসে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ প্যারিস সম্মেলনে (২০১৫ সালে) বিশ্ব একমত হয়েছিল- তাপমাত্রার বিপজ্জনক বৃদ্ধি ঠেকাতে তারা কার্বন নির্গমন কমাবে।

কপ-২৬ সম্মেলনেও অন্যতম ইস্যু ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা। অন্যদিকে সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩৪টি দেশ। তবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য ২০৬০ সালকে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে। গ্লাসগোতে চীন নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার নিয়ে প্রস্তাবে আপত্তি জানায় দেশটি।

কার্বন নিঃসরণ না কমালে পৃথিবীর সব দেশেরই সমস্যা- মন্তব্য করে অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি সব বাড়বে। এটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়া। কোনো একক দেশের সমস্যা নয়। বড় দেশগুলোকেই উদ্যোগ নিতে হবে। যারা দূষণের জন্য দায়ী।

পরিবেশবিদ ইকবাল হাবিব ভোরের কাগজকে বলেন, কার্বন না কমানোর কারণে আমাদের সমুদ্রের তলদেশ বেড়ে যাচ্ছে। সাতক্ষীরা অঞ্চলে লবণাক্ত পানি বাড়ছে। কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। অভিবাসী হচ্ছে। জমির ওপর চাপ পড়ছে। একটা সমস্যা থেকে আরেকটা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ু ও বৈশ্বিক সমস্যার কারণে যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি হচ্ছে না, আবার অকাল বন্যায় প্লাবিত হচ্ছে।

এর কারণে মানুষ জীবন-জীবিকা ও বসত হারাচ্ছে। নগর ও কৃষির ওপর চাপ পড়ছে। অভিযোজনজনিত চাপ বাড়ছে। নদী-খাল নির্বিচারে ভরে যাচ্ছে। পৃথিবীর তিনটি গ্লেসিয়ারের তলে আমরা। বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাহলে বরফগলা নদীর পানি প্রবাহিত হবে, যা সামাল দেয়া যাবে না।

কপ-২৬ এ আশার আলো : বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখা, ফসিল ফুয়েল বিশেষ করে কয়লা থেকে সরে আসা আর ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আর অর্থায়নের মতো ইস্যুতে কপ-২৬ সম্মেলনকে ঘিরে ছিল অনেক প্রত্যাশা।

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন শেষে হতাশা যেমন দেখা গেছে তেমন কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে আশাবাদীও বিশেষজ্ঞরা।

গ্লাসগো সম্মেলন থেকে যেসব পদক্ষেপের ঘোষণা এসেছে, তার মধ্যে- বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমিত রাখার অঙ্গীকার; অভিযোজন অর্থাৎ জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় অর্থায়ন দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার; জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো যে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণে যে বাড়তি সহায়তা প্রয়োজন, তার স্বীকৃতি এবং প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিতে উৎসাহিত করা, কার্বন গ্যাসের লেনদেনে স্বচ্ছতা ও নিরীক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্যারিস রুল বুক নামে পরিচিত বিধিমালাও চূড়ান্ত, গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোসহ সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি দেশকে প্রতি বছর তাদের জাতীয় ভূমিকার অঙ্গীকার বা এনডিসি হালনাগাদ করা, যাতে বার্ষিক পর্যালোচনার কারণে বড় দূষণকারীদের ওপর কিছুটা চাপ বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App