×

জাতীয়

প্রতারিত হয়েই প্রতারণায় জড়ায় চক্রের হোতা বেলাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৩:০০ পিএম

বেলাল হোসেন। একটা সময়ে ফেরি করে নানা পণ্য বিক্রি করা পেশা ছিল। কিন্তু এতে আর্থিক টানাপোড়েন কাটছিল না তার। ভাগ্য উন্নয়নে মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে কাজের সুযোগ পান। সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করে সরকারি নিয়ম মেনে গত বছরের মার্চ মাসে কুমিল্লা জেলার একটি হাসপাতালে করোনা টেস্টের নমুনা দেন।

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি হাসপাতালের ডাক্তার পরিচয় দিয়ে জানায় বেলালের করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে। কিন্তু তার করোনার ফলাফল পরিবর্তন করা সম্ভব। এ জন্য দিতে হবে দশ হাজার টাকা। কিন্তু টাকা দেয়ার পরেও মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে করোনার ফলাফল পজিটিভ আসে। বিশ্বাস করে টাকা দিয়ে বিদেশে না যেতে পেরে সে হাসপাতালে যোগাযোগ করে।

হাসপাতাল থেকে বেলালকে জানানো হয় ডাক্তার পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা ব্যক্তির নামে কেউ হাসপাতালে কাজ করে না। বেলাল বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। পুনরায় একই বছরের এপ্রিল মাসে করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসার পর মধ্যপ্রাচ্যে চলে যায়।

তবে এর আগে করোনা টেস্ট করতে গিয়ে প্রতারণার বিষয়টি মানতে পারেননি বেলাল। তিনি প্রতিটি পদক্ষেপ বিচার বিশ্লেষণ করেন। যেভাবে সে নিজে প্রতারণার শিকার হয়েছে একইভাবে বিদেশগামীদের কাছ থেকে করোনার টেস্টের ফল পরিবর্তন করে দেয়ার কথা বলে প্রতারণার জন্য একটি রূপরেখা তৈরি করে। সেই অনুযায়ী বিদেশে যাওয়ার আগে বেলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সবুজকে নিয়ে একটি চক্র গড়ে তোলে। বন্ধু সবুজের সঙ্গে হাতিয়ে নেয়া টাকার ভাগাভাগির চুক্তি করে বেলাল প্রবাসে চলে যায়। আর এভাবেই প্রতারণার শিকার বেলাল হয়ে উঠলেন অভিনব এক প্রতারক চক্রের হোতা।

প্রায় এক বছর ধরে অভিনব কায়দায় চলা প্রতারণা চক্রের মূল বেলাল ও তার অন্যতম সহযোগী সবুজসহ ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-১১।

র‌্যাব বলছে, এই চক্রটির সঙ্গে কোনো হাসপাতালের যোগাযোগ না থাকলেও শুধু মাত্র করোনা টেস্ট দিতে আসা মানুষের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে অভিনব উপায়ে করোনার ফল পরিবর্তন করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিত। এভাবে চক্রটি কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতারক চক্রের অভিনব এ প্রতারণার বিষয়ে জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, বিদেশগামী যাত্রীদের করোনা টেস্ট নেগেটিভ ফলাফল বদলে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের ১৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চক্রটি প্রায় এক বছর ধরে প্রতারণা করে আসছিল।

গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানী ঢাকা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় র‌্যাব-১১ এক দল অভিযান চালিয়ে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো জসিম উদ্দিন (২২), সুলতান মিয়া (১৯), বেলাল হোসেন (৩১), আবুল হোসেন (২৪), আবদুল নুর (২১), আলফাজ মিয়া (১৯) শামিম (৩২), আহাম্মদ হোসেন (১৯), ইমরান উদ্দিন মিলন (১৯), সবুজ মিয়া (২৭), আব্দুর রশিদ (২৮), আব্দুল করিম চৌধুরী (৩২) আঙ্গুর মিয়া (২৫), আলমগীর হোসেন (২০)।

এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে আয় করা সাত লাখ টাকা, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১২০টি সিমকার্ড, ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, ট্যাব, ৩২টি মোবাইল, একটি পাসপোর্ট, নোটবুক এবং চক্রের সদস্যদের বেতনের হিসাব বিবরণী জব্দ করা হয়।

যেভাবে প্রতারণা করা হতো:

গ্রেপ্তার প্রতারক চক্রের সদস্যদের বরাত দিয়ে মঈন বলেন, আবুল হোসেন নারায়ণগঞ্জ ও বি-বাড়িয়া জেলায় আব্দুর নূর নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় আহাম্মেদ হোসেন চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জ জেলায়, আব্দুর রশিদ ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলায় আব্দুল করিম কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়; আলমগীর সিলেট, মৌলভি বাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায়; আঙ্গুর মিয়া কুমিল্লা, মৌলভিবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলায় করোনা টেস্টের জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সকাল সাতটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত বিদেশগামী যাত্রী ছদ্মবেশে অবস্থান নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের মোবাইল নম্বরগুলো সংগ্রহ করত। নম্বরগুলো সংগ্রহ করে বেলাল ও সবুজকে পাঠাত তারা। বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের প্রকৃত করোনা টেস্টের ফলাফল হাতে পাওয়ার আগেই বেলাল ও সবুজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের করোনা টেস্ট বিভাগের ডাক্তার অথবা হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের পরিচয় দিয়ে করোনা টেস্টের ফলাফল পজিটিভ এসেছে জানাত। পরে পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিত।

চক্রের অন্য সদস্য আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান একই সময়ে বেলাল ও সবুজকে বিভিন্ন জায়গার মোবাইল ব্যাংকিং এর নাম্বার সরবরাহ করত। ভূক্তভোগীরা বেলাল ও সবুজ এর কথা অনুযায়ী এই সকল নম্বর মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টাকা পাঠালে আলফাজ, জসিম, শামিম ও সুলতান তা সংগ্রহ করতো। টাকা সংগ্রহের অবস্থান সব সময় ভিন্ন ভিন্ন জেলায় নির্ধারণ করা হতো, যাতে কেউ প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে না পারে। একটি সিম একদিন ব্যবহার করে তা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় ব্যবহার করতো এবং কোনো নাম্বার নিয়ে সন্দেহ হলে তা ফেলে দিত। প্রতারণার পুরো কাজটি করতে যে সিমগুলো ব্যবহার করা হতো সেগুলো সরবরাহ করতেন মিলন। ১২০ টাকায় কেনা সিম চক্রের কাছে ১ হাজার করে বিক্রি করা হত।

মিলন যেভাবে সিম সংগ্রহ করতো:

চক্রের কাছে শতাধিক সিম সরবরাহ করে আসছিল ইমরান উদ্দিন মিলন। মিলন ফুটপাতে সিম বিক্রির আড়ালে সাধারণ মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যবহার করে সু-কৌশলে শত শত মোবাইল সিম তুলে নিত। ১২০ টাকায় কেনা প্রতিটি সিম মিলন বেলাল ও সবুজদের কাছে এক হাজার টাকা করে বিক্রি করত।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, প্রতারণার মাধ্যমে চক্রটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। চক্রের অন্যতম হোতা সবুজ এক বছরে চক্রটি হাজারের অধিক বিদেশ যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে। তারা প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিত। সবুজ এই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি ভবন তৈরি করেছে। অন্যদিকে বেলাল হোসেন প্রতারণার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যাতায়াত করেছে। বেলালও ছয় শতাধিক বিদেশগামী যাত্রীদের সঙ্গে একই কায়দায় প্রতারণা করেছে। এভাবে ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য জানিয়েছে। চক্রের অন্য সদস্যরা প্রতিদিন হাজিরা ভিত্তিতে আটশত থেকে এক হাজারা টাকা করে দেয়া হত।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আল মঈন বলেন, এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তাদের টার্গেট ছিল বিদেশগামী যাত্রীরা। এই সকাল মানুষের যারা তথ্য সংগ্রহ করত তাদেরকে দৈনিক ভিত্তিতে এক হাজার টাকা দেয়া হত। যারা মোবাইল ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করতো তাদেরকে দৈনিক আটশত থেকে এক হাজার টাকা দেওয়া হত। এছাড়াও চক্রের সদস্যদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করতে বলা হত। কেউ মোবাইল ব্যাংকিং, হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ, মোবাইলে কথা বলা, পজিটিভ থেকে নেগেটিভ করা ইত্যাদি আলাদা আলাদা সেক্টরে কাজ করতেন তারা।

গ্রেপ্তার মিলনের বিষয়ে তিনি বলেন, এই চক্রের মিলন সিম সরবরাহের কাজ করত। সে রাস্তার পাশে মোবাইল সিম বিক্রির নামে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদের কাছ থেকে বারবার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে একাধিক সিম নিজে রেখে দিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App