×

জাতীয়

কাউন্সিলরের বাধায় বন্ধ তুরাগ তীরের ওয়াকওয়ে নির্মাণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:২৭ এএম

কাউন্সিলরের বাধায় বন্ধ তুরাগ তীরের ওয়াকওয়ে নির্মাণ

তুরাগ তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ছবি: ভোরের কাগজ

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বাধার মুখে বন্ধ হয়ে গেছে তুরাগ তীরে ওয়াকওয়ে নির্মাণের কাজ। সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। তবুও সমাধান হয়নি। এতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি গুনতে হচ্ছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। এর আগেও সেখানে সীমানা পিলার স্থাপন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়তে হয়েছিল আরেক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএর অতিউৎসাহী কিছু কর্মকর্তার কারণে তুরাগে সীমানা নির্ধারণ ইস্যুটি সঠিকভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। ফলে অহেতুক মামলা মোকাদ্দমায় জড়িয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের।

রাজধানীকে ঘিরে থাকা তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যা রক্ষায় তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। দ্বিতীয় পর্যায়ের (সংশোধিত) এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। এরই মধ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের বিভিন্ন অংশে সীমানা পিলার স্থাপনসহ ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি উত্তরখানের মোশাইদ এলাকার ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ স্থানীয়দের নিয়ে বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ ওঠে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জাইদুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধে। ওই অংশের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের আগস্ট মাসে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা।

বিষয়টি উল্লেখ করে গত ১৭ জানুয়ারি উত্তরখান থানায় জিডির আবেদন করেন প্রকল্প পরিচালক ও বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু জাফর মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ কবির। ১৮ জানুয়ারি জিডিটি রেকর্ড করা হয়। এতে বলা হয়, উচ্চ আদালতের রিট পিটিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর তীরভূমিতে পিলার স্থাপন, তীররক্ষা, ওয়াকওয়ে ও জেটিসহ আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের’ আওতায় ঢাকার চারদিকের বৃত্তাকার নৌপথের দুই তীরে সীমানা পিলার এবং ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। সম্প্রতি মোশাইদ ও উত্তর খান মৌজায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজে কিছু ব্যক্তি বাধা দিচ্ছে। একই চক্র এর আগে সীমানা পিলার স্থাপনের সময়ও বাধা দিয়েছিল উল্লেখ করে জিডিতে বলা হয়, এ নিয়ে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল তুরাগ থানায় তৎকালীন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একটি মামলা করে। ওই মামলার এজহারভুক্ত আসামিরাই আক্রোশের বশবর্তী হয়ে এখন ওয়াকওয়ের কাজে বাধা দিচ্ছে। যদিও এই জিডিতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় নদীর তীর নির্ধারণ নিয়ে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তির আপত্তি রয়েছে। তারা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাইদুল ইসলাম মোল্লার নেতৃত্বে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। বিষয়টি নিয়ে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক কথা বলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। এরপর মেয়র নিজেই ওই কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলেন। তবে এখন পর্যন্ত বিষয়টির সমাধান হয়নি। অভিযোগ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর জাইদুল ইসলাম মোল্লাকে ফোন করা হলে তিনি গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় জানার পর ফোনটি কেটে দেন। এরপর আর কল ধরেননি তিনি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, এসএসআর গ্রুপ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওই এলাকায় কাজ করার জন্য ইট-পাথর, রড-সিমেন্ট প্রভৃতি জমা করে রেখেছে। এক্সকাভেটর, রিগসহ বেশ কিছু ভারী যন্ত্রপাতিও রয়েছে সেখানে। নির্মাণ শ্রমিকরা সেগুলো পাহারা দিচ্ছে। কাজ বন্ধ করে দেয়ার পর বিভিন্ন সময়ে সন্ত্রাসীরা এসে তাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্মাণ কর্মীরা। এসএসআর গ্রুপের চেয়ারম্যান রকিবুল আলম দিপু এ প্রসঙ্গে বলেন, কিছু লোক বাধা দিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এর পেছনে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মদদ আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। বিষয়টি বিআইডব্লিউটিএকে জানানো হয়েছে। তিনি জানান, যন্ত্রপাতি ভাড়া, শ্রমিকের বেতনসহ প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা তার প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হচ্ছে।

তবে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, বিআইডব্লিউটিএ তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে পিলার স্থাপন করেছে। মোশাইদের সামছুল ইসলাম জানান, বাপ-দাদার আমল থেকেই তারা এই জমি ভোগদখল করে আসছেন। সরকারি কোষাগারে খাজনা দিয়েছেন। এখন বিআইডব্লিউটিএ বলছে, এটি নদীর জমি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের কোনো কথাই আমলে নেননি। জোর করে সীমানা পিলার বসিয়েছেন। তারা কাগজপত্র দেখাতে গেলে সেগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। নদী রক্ষায় জমি নিতে হলে সাধারণ মানুষকে কেন ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে না- পাল্টা সে প্রশ্ন করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) একটি রিটকে কেন্দ্র করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম বুড়িগঙ্গাকে দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০০১ সালে প্রথম উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ২০০৪ সালে বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যাকেও অভিযানের আওতায় আনা হয়। ২০০৫ সালে প্রথম ঢাকা জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথ জরিপের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের তীরভূমি নির্ধারণ করে এবং পিলার স্থাপনের কাজ শুরু করে। কিন্তু সঠিকভাবে পিলার স্থাপন করা হচ্ছে না বলে তখন অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে ২০০৯ সালে রিট (৩৫০৩) করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। ওই রিটের আদেশে নদী রক্ষায় আদালত বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। সে আলোকে ২০১২ সালে জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর, বিআইডব্লিউটিএসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো আবারো যৌথ জরিপের মাধ্যমে নদীর তীরভূমির লে-আউট প্রস্তুত করে। প্রথমে গণপূর্ত বিভাগ ও পরে বিআইডব্লিউটিএ নিজেরাই বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যায় সীমানা পিলার স্থাপন করে। কিছু কর্মকর্তার কারণে বিতর্কেও জড়ায় সংস্থাটি। ২০১৯-২০ সালে এ সংক্রান্ত কয়েক’শ অভিযোগ জমা পড়ে বিআইডব্লিউটিএতে। মামলা-মোকাদ্দমাও হয় অনেক। মোহাম্মদপুর ও হাজারীবাগের বছিলা এলাকার সাড়ে ৪০০ বছরের পুরান গ্রাম উচ্ছেদের অভিযোগে গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকার ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনে সংবাদ সম্মেলন করেন কিছু মানুষ।

আবার অভিযান চালাতে গিয়ে দখলদারদের বাধার মুখেও পড়তে হয় উচ্ছেদকারীদের। ২০০২ সালে কেরানীগঞ্জের জেলা পরিষদ মার্কেট, কামরাঙ্গীর চরে হাফেজ কামালের ঠোঁটা, ২০০৪ সালে কাঁচপুর ব্রিজের নিচে তৎকালীন সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিনের কাশসাফ স্টোনের গদিতে অভিযানের সময় হামলার ঘটনা ঘটে। ২০১৯-২০ সালে মোহাম্মদপুরে আমিন মোমিন হাউসিং, মাইশা পাওয়ার প্লান্টসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানোর সময়ও উচ্ছেদে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এ সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকজনকে সাজাও দেন। আর সম্প্রতি উত্তরখান এলাকায় ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ উঠল ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App