×

সাহিত্য

বিপ্লবের মহানায়ক সূর্য সেনের ৯১তম ফাঁসি দিবস কাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:১৬ পিএম

বিপ্লবের মহানায়ক সূর্য সেনের ৯১তম ফাঁসি দিবস কাল

ছবি: সংগৃহীত

বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের আত্মোৎসর্গের ৯১তম ফাঁসি দিবস শুক্রবার (১২ জানুয়ারি)। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি এই দিনে দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ব্রিটিশ শাসকেরা যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। 

মাস্টারদা সূর্য সেন ছিলেন ভারতবর্ষের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। তার আসল নাম সূর্য কুমার সেন। তবে তিনি মাস্টারদা নামে সমধিক পরিচিত, তার ডাকনাম ছিল কালু। ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

পেশায় ছিলেন শিক্ষক সূর্য সেন ১৯১৬ সালে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। বিপ্লবীদের গোপন ঘাঁটি ওই কলেজে তিনি অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে আসেন এবং যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত হন। সূর্য সেনকে তিনি বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষা দেন। সূর্য সেন ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ৪৯নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টের নগেন্দ্রনাথ সেন ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে এসে সূর্য সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী ও চারুবিকাশ দত্তের সঙ্গে দেখা করেন। সূর্য সেন এবং তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী অম্বিকা চক্রবর্তী একই থানার পাশাপাশি গ্রামের ছাত্র হিসেবে ছোটবেলা থেকেই পরস্পরের কাছে পরিচিত ছিলেন।

বিপ্লবী ভাবধারায় দীক্ষিত সূর্য সেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকে একমাত্র তপস্যা হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বিবাহ-বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বিএ পাশ করে চট্টগ্রামে আসার পর থেকেই অভিভাবকরা তার বিয়ের কথাবার্তা তোলেন। অবশেষে তার বড়ভাই শিক্ষক চন্দ্রনাথ সেন (সহোদর নয়) ও অন্যান্য আত্মীয়দের বিশেষ অনুরোধে ১৯১৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের ষোল বছরের কন্যা পুষ্প কুন্তলা দত্তকে বিয়ে করেন।

বিয়ে করলেও মাস্টারদার মনে এ ধারণা বলবৎ ছিল যে, বিবাহিত জীবন তাকে কর্তব্য ভ্রষ্ট ও আদর্শচ্যুত করবে। তার ফলে স্ত্রীর সঙ্গে তিনি একদিনও কথা পর্যন্ত বলেন নি। বিয়ের তৃতীয় দিনে হিন্দুদের মধ্যে যে ফুলশয্যার প্রথা প্রচলিত আছে সেটিও তিনি পালন করেননি। সেদিন তিনি তার বৌদিকে বলেন, তিনি স্বপ্নে দেখেছেন স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসে তার মৃত্যু অনিবার্য। তাই তিনি সেদিনই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরে চলে আসেন এবং তারপর স্ত্রীর সঙ্গে আর কোনদিন দেখা করেননি।

এদিকে সূর্য সেনসহ ছয়জন শীর্ষস্থানীয় বিপ্লবীকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার ৫০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৩০ সালের ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে (চট্টগ্রাম সেনানিবাসের পাহাড়) অবস্থান করছিল সে সময় সশস্ত্র ইংরেজ সৈন্যরা তাদের আক্রমণ করে। দুই ঘণ্টার প্রচণ্ড যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৭০ থেকে ১০০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন।

ইংরেজ প্রশাসন সূর্য সেনকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখে। ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অস্ত্রসহ সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেন ধরা পড়েন। ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সূর্য সেন এবং ব্রজেন সেনকে প্রথমে জেলা গোয়েন্দা সদর দপ্তরে, পরে কোর্ট হয়ে চট্টগ্রাম জেলে নেয়া হয়। সূর্য সেন গ্রেপ্তার হবার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন সম্পর্কে ফেরারী সূর্য সেনকে গত রাতে পটিয়া হইতে ৫ মাইল দূরে গৈরলা নামক স্থানে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। সূর্য সেনকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের মামলায় প্রধান আসামি বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। গত ১৯৩০ সাল হইতে সূর্য সেন পলাতক ছিলেন এবং তাহাকে ধরাইয়া দিবার জন্য গভর্নমেন্ট দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করিয়াছিলেন’।

১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ব্রিটিশ শাসকেরা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। ঐ সময় জেল গেটের বাইরে শহীদ সূর্য সেনের সহযোদ্ধারা অপেক্ষা করছিলেন, তাদের প্রিয় সহকর্মী, নেতাকে স্যালুটের মাধ্যমে বিদায় জানাবেন। তাকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য আরেকবার জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেবেন।

কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা জীবিত সূর্য সেনকে যেমন ভয় পেত, তেমনি ভয় পেত সূর্য সেনের মৃতদেহকেও। জানা যায়, সূর্য সেনকে ব্রিটিশ সেনারা নির্মমভাবে অত্যাচার করে। ব্রিটিশরা হাতুড়ী দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং তার হাড়ও ভেঙে দেয়। এরপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। নিষ্ঠুরভাবে তার অর্ধ মৃতদেহটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। সূর্য সেনের লাশ আত্মীয়দের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি এবং হিন্দু সংস্কার অনুযায়ী পোড়ানোও হয়নি। ফাঁসির পর লাশটি জেলখানা থেকে ট্রাকে করে ৪ নম্বর ষ্টীমার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর মৃতদেহটি এক ব্রিটিশ ক্রুজারে তুলে নিয়ে বুকে লোহার টুকরা বেঁধে বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগর সংলগ্ন একটা জায়গায় ফেলে দেয়া হয়।

ফাঁসিতে যাওয়ার আগে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে সূর্য সেন লেখেন, ‘...আমার বন্ধুরা এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই...’ 

এভাবেই ২০০ বছরের ব্রিটিশবিরোধী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নানা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংগঠিত এই যুব বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামকে তিনদিনের জন্য স্বাধীন করে রাখা হয়েছিল।

ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। ঐ সময় চট্টগ্রামের ব্রিটিশ শাসক আর বণিকরা আশ্রয় নিয়েছিল সমুদ্রে। সূর্য সেন বাহিনী অল্প স্বল্প অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেও পরবর্তীতে সংগঠিত হয়ে বিপুল বাহিনী ও ব্যাপক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিষ্ঠুরভাবে এই বিদ্রোহ দমনের পথ বেছে নেয় ব্রিটিশ শাসকেরা।

মহান এ বিপ্লবীর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়। এছাড়া কলকাতা মেট্রো, সূর্য সেনের স্মরণে বাঁশদ্রোণী মেট্রো স্টেশনটির নামকরণ করেছে মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশন। 

বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পংকজ চক্রবর্তী ভোরের কাগজকে জানান, শুক্রবার সকালে চট্টগ্রামের জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে মাস্টারদা সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App