×

সাহিত্য

অন্যরকম এক পহেলা বৈশাখ উদযাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২০, ০৮:০৫ পিএম

অন্যরকম এক পহেলা বৈশাখ উদযাপন

নববর্ষ ১৪২৭

ছিল না কোনো উৎসবের রঙ, ছিল না ঢাকের বাদ্যি, ছিল না পান্তা-ইলিশের বাহার কিংবা হালখাতা খুলে মিষ্টিমুখ। গলি থেকে রাজ পথ শূন্য। নিজেকে বৈশাখের রঙে রঙিন পোশাকে রাঙিয়ে তরুণ তরুণী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা বা শিশুরা বের হয়নি। হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। এ এক অন্যরকম অচেনা পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেছে দেশবাসী।

করোনা মহামারীর থাবায় পহেলা বৈশাখ আর নতুন বর্ষ উদযাপনে ছিল না কোনেই আয়োজন। মানুষ যার যার ঘরে বসেই উদযাপন করেছে দিনটি। যাদের সামর্থ্য ও সুযোগ ছিল তাদের কেউ কেউ পান্তা ইলিশের আয়োজন করেছেন বাসায়। মোবাইল ম্যাসেজ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। সবার পহেলা বৈশাখ কেটেছে বাসাতে বসেই। কেউ কেউ টিভিতে বসে ডিজিটালি ধারণ করা পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ আয়োজন:

পহেলা বৈশাখ ডিজিটালি পালন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আলোকে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার পহেলা বৈশাখ উদযাপন করেছে ধারণকৃত একটি অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে। চ্যানেল আইয়ে পহেলা বৈশাখের সকালে ‘এসো হে বৈশাখ’ শিরোনামের এই অনুষ্ঠান প্রচার করা হয় পহেলা বৈশাখের সকাল সাড়ে আট টায়। এই আয়োজনে বৈশাখ উপলক্ষে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের কারিগরি সহায়তায় অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এজাজ খান স্বপন। এ অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ পর্বে অংশ নিয়েছেন ড. নুজহাত চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ইয়াসমিন মুশতারী, সাদী মহম্মদ, সামিনা চৌধুরী ও শফি মন্ডল। আবৃত্তি করেন আসাদুজ্জামান নূর।

সংস্কৃতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তার বাণীতে দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘বাঙালির সার্বজনীন প্রাণের উৎসব বাংলা নববর্ষ। আমরা প্রতিবছর নববর্ষকে আবাহন করি প্রাণের স্পন্দনে, গান-কবিতায়, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে, আবেগ-উল্লাসে। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব বর্তমানে এক মহাদুর্যোগকালিন সময় অতিবাহিত করছে। করোনাভাইরাসজনিত রোগ (কোভিড-১৯) সমগ্র বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করায় বাংলাদেশে এই রোগের বিস্তার রোধকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থের কথা চিন্তা করে বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করেছেন।

তিনি বলেন, আমরা সকলেই জানি, জনসমাগম পরিহার করা বা এড়িয়ে চলা এ মহামারি থেকে দেশকে মুক্ত রাখার অন্যতম উপায়। সে বিষয়টি বিবেচনা করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বাংলা নববর্ষের দিনসহ সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যথাসম্ভব জনসমাগম পরিহার করে ঘরে থাকা আবশ্যক। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপনের জন্য সকলকে আহ্বান জানাই। এক্ষেত্রে আমরা সহায়তা নিতে পারি রেডিও, টেলিভিশন, প্রিন্ট এবং সোশ্যাল মিডিয়াসহ আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণের।

ছায়ানটের ডিজিটাল আয়োজন:

পহেলা বৈশাখের অন্যতম আয়োজন রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন। কিন্তু সেই রমনা বটমূলে এবার ছিল শুনশান নিরবতা। তবে সাধারণ মানুষের জন্য আগের আয়োজন থেকে বাছাই করে গান-কবিতাগুলো নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান সাজায় দেশের ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি। মঙ্গলবার সকাল ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের সঙ্গে যুথবদ্ধভাবে বিশেষ প্রভাতী আয়োজন প্রচারিত হয়। যা চলে সকাল পৌনে আটটা পর্যন্ত।

১৯৬৭ সালে ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন শুরু হয়েছিলো ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায়’ গানটির মধ্যে দিয়ে। শুরুর এ গানটি দিয়ে ২০১৭ সালে ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনও শুরু করেছিলো ছায়ানট। বিশেষ ব্যবস্থার এ আয়োজনটিও শুরু হয় এ গান দিয়ে। এর পর একে একে প্রচারিত হতে থাকে গান। যেসব গানে বর্ণিত হয়েছে মানুষের জয়গান। সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত হয় ‘ওই প্রভাত’, ‘নাই নাই রে ভয়’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’সহ আরো কয়েকটি গান। খায়রুল আনাম শাকিল কাজী নজরুল ইসলাম, লাইসা আহমেদ লিসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চন্দনা মজুমদারের কণ্ঠে লালন সাঁইয়ের গান প্রচারিত হয়। আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠ কবি দিলওয়ারের কবিতা ‘ক্ষমা করবেন শ্রদ্ধেয় পিতা’ আয়োজনে ভিন্ন মাত্রা দেয়।

এর পর ছায়ানট সভাপতি সানজীদা খাতুনের সমাপনী কথন প্রচারিত হয়। যেখানে তিনি বলেন, উৎসবের দিন নয় আজ। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করবার দিন। নিজে নিরাপদ থাকার পাশাপাশি সবাইকে নিরাপদ রাখার সময়। এই সর্বব্যাপী বিপদে আক্রান্ত বিরূপ বিশ্বে মানুষ একা হয়ে পড়েছে, আবার সব বিশ্ববাসী আজ একই সংগ্রামের সহযাত্রী হয়ে মিলেমিশে একাকার।

ছায়ানট সভপাতি সবাইকে বাংলা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, পৃথিবীর ঘরে ঘরে যত মানুষ আছে, সবার জন্য শুভকামনা জানাই আমরা। জয় আমাদের হবেই। সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা ফিরে উচ্চারণ করব আজ ‘জয় হোক মানুষের, ওই চিরজীবিতের’। ছায়ানটের রীতি অনুযায়ী, জাতীয় সঙ্গীত প্রচারের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ডিজিটাল প্রভাতী আয়োজন।

হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রা:

মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর রমনার বটমূল এবং চারুকলা অনুষদ ঘুরে দেখা গেছে, সুনশান ও নিস্তব্ধ রমনার বটমূল এলাকার পুরোটাই। তালা ঝুলছে রমনা পার্কে প্রবেশের প্রধান গেটগুলোতে।

এবারের বৈশাখে ছিল না মঙ্গল শোভাযাত্রার কোনো আয়োজন। মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাালয়ের চারুকলা অনুষদের ডীন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলা নববর্ষকে পেয়েছি, যখন বিশ্বে আনন্দ উৎসব আয়োজন করার মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। বরং এক অত্যন্ত কঠিন মর্মান্তিক পরিবেশের সামনে দাঁড়িয়ে আজকে আমাদের বছরের এই প্রথম দিনটি উদযাপন করতে হচ্ছে। আমরা আমাদের এই সময়ে যে রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, সেই লড়াইয়ের ধরনটাই হচ্ছে জিততে গেলে আমাদের ঘরে অবস্থান করতে হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলাম এবং আমরা জয়ী হয়েছিলাম। এই করোনার বিরুদ্ধে আমাদের যে যুদ্ধ তার জন্য আমাদের ঘরে অবস্থান করতে হবে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

এবারের পহেলা বৈশাখে সবাই যার যার বাসায় বসেই উদযাপন করেছেন। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক আয়োজন করেছিল উদীচী। দেশের শিল্পী সমাজের অনেককেই দেখা গেছে ফেসবুকে পহেলা বৈশাখের গান, আবৃত্তি নিয়ে মুখর থাকতে।

ঘরেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনে করোনা মুক্ত বাংলামেশের প্রত্যাশা আইনমন্ত্রীর:

নতুন বছরে করোনাভাইরাসকে (কোভিড-১৯) প্রতিরোধ ও নিরাময় করে শিগগিরই করোনামুক্ত বাংলাদেশে আবারও উৎসবের আনন্দে মিলিত হওয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। মঙ্গলবার সকালে আইনমন্ত্রী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

‘বাংলা নববর্ষ-১৪২৭’ উপলক্ষে দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, করোনাভাইরাসজনিত রোগ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ এড়াতে এ বছর আমরা ঘরে থেকেই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান উদযাপন করব এবং এটি হবে বাঙালি জাতির জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, এ নতুন অভিজ্ঞতা নিয়েই আমরা অতীতের সব গ্লানি ধুয়ে-মুছে সামনে দৃপ্ত-পায়ে এগিয়ে যাব। নতুন বছরে কোভিড-১৯ কে প্রতিরোধ ও নিরাময় করব এবং শিগগিরই করোনামুক্ত বাংলাদেশে আবারও উৎসবের আনন্দে মিলিত হব ইনশাল্লাহ।

আনিসুল হক বলেন, বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। প্রতি বছর অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে নানান ঐতিহ্য পালনের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে থাকে বাঙালি জাতি।

মন্ত্রী আরো বলেন, কিন্তু এ বছর নতুন সংক্রামক রোগ কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক মহামারির কারণে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘরে বসেই পালন করতে হচ্ছে। সরকার জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ এই রোগ ইতোমধ্যে বাংলাদেশেও সংক্রমিত হয়েছে এবং এর সংক্রমণ এড়াতে আমরা এখন ঘরেই রয়েছি। ঘরে থাকাই এ রোগ প্রতিরোধের উত্তম উপায়।

সবাইকে ঘরে থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠান উপভোগ করার আহ্বান জানান সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App