×

সাহিত্য

অসাম্প্রদায়িকতা রুখতে চাই নজরুল চর্চা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০ পিএম

অসাম্প্রদায়িকতা রুখতে চাই নজরুল চর্চা
অসাম্প্রদায়িকতা রুখতে চাই নজরুল চর্চা
অসাম্প্রদায়িকতা রুখতে চাই নজরুল চর্চা
অসাম্প্রদায়িকতা রুখতে চাই নজরুল চর্চা

জাতীয় অনুষ্ঠানে জাতীয় কবির গান নেই: খিলখিল কাজী

অসাস্প্রদায়িকতা রুখতে বিদ্রোহী কবির আদর্শ চর্চা আর অধ্যয়নের আহ্বান জানানো হয়েছে।

রবিবার (২৭ আগস্ট) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে দিনব্যাপী আয়োজনে এ আহবান জানানো হয়েছে। আরো বলা হয়, কবির বিদ্রোহী সত্তা যে উৎপীড়িত, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের কথা বলেছে; আজকে পৃথিবীতে যে হানাহানি, জাতিগত বিভেদ চলছে- এই সময়ে কবির লেখা আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে শক্তি যোগায়। নজরুলের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে অপশক্তিকে রুখতে জাতিকে নজরুল চর্চার আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী।

মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল সকালে কবির মাজারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ ও আলোচনা সভা। বিকেলে বিভিন্ন সংগঠনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন ও বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন নজরুলের গান, আলেখ্যানুষ্ঠান ও নাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত কবিকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিবসের কর্মসূচি।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবির সমাধিতে ছুটে আসেন তার পরিবারের সদস্য, ভক্ত, অনুরাগী ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। কবির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সমাধিতে। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পাশাপাশি কবি আত্মার শান্তি কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। এরপর একে একে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

সকাল পৌনে সাতটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন। এরপর সমাধি প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সকাল সাতটার দিকে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কবির সমাধিতে যান। সেখানে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ও পরে দলের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তারা। আওয়ামী লীগের পর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ দলের নেতাকর্মীরা জাতীয় কবিকে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।

কবির সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নজরুল গবেষণা কেন্দ্র, ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল, যুব মহিলা লীগ, জাতীয় সাংস্কৃতিক সমিতি (জাসাস), বাংলাদেশ কৃষকলীগ, বঙ্গবন্ধু শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, মহিলা আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী যুবলীগসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি ও সংগঠন।

শ্রদ্ধা নিবেদন করে কবির নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, ‘জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে কবির কাজী নজরুল ইসলামের গান বাজানো হয় না। অথচ তার গান দেশের যে কোনো সংকট মুহূর্তে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। ‘চল চল চল’ গানটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রণসংগীত করেছিলেন। সেই গানটাও এখন সেভাবে গাওয়া হয় না। ‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার হে’ গানটিও জাতীয় পর্যায়ে আমরা ব্যবহার করা দরকার। এটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গান।’

কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যসম্ভার বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে খিলখিল কাজী বলেন, তার রচনাগুলো আজও পর্যন্ত অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এটা সরকারের দায়িত্ব। তার অজস্র সৃষ্টি আমাদের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এগুলো সংগ্রহ করা সরকারসহ আমরা ব্যক্তিগতভাবে যারা কাজ করছি, সবার দায়িত্ব।

বাংলা একাডেমিতে কবির ব্যবহৃত বর্ধমান হাউজের কক্ষটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে খিলখিল কাজী বলেন, আপনারা জানেন, তিনি যখনই ঢাকায় আসতেন, বর্ধমান হাউজে তিনি উঠতেন। বর্ধমান হাউজটা কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়নি। আমার মনে হয়, অবিলম্বে তার ব্যবহৃত কক্ষটি সংরক্ষণ করে কবির যাবতীয় জিনিস গুছিয়ে রাখা উচিত।

কবির সমাধিতে ফুল দেয়া শেষে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, নজরুল চিরদিনই আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। তিনি আগেও প্রাসঙ্গিক ছিলেন, এখনো তিনি বাঙালির জীবনে প্রাসঙ্গিক। জাতীয় কবি যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা, গানে চেতনার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, সেই সাম্প্রদায়িকতা এখনো আমাদের এই স্বাধীন দেশে অগ্রগতির পথে, বিকাশের ধারায় অন্তরায় হয়ে আছে। তাই আজকের দিনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে সমূলে ধ্বংস করব এই শপথ করি এবং বাংলাদেশে যারা সত্যিকারের বাঙালি তাদের কাছেও এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাই।

বাংলা একাডেমি বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সকাল ১১টায় বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন এবং মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদার নেতৃত্বে একাডেমির নজরুল মঞ্চে স্থাপিত নজরুল ভাস্কর্যে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

সকালে একাডেমির অবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। নজরুল বিষয়ক একক বক্তৃতা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. বেগম আকতার কামাল। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে নজরুলের পত্র পাঠ করেন বাচিকশিল্পী নূরননবী শান্ত এবং নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেন বাচিকশিল্পী বেলায়াত হোসেন। নজরুলগীতি পরিবেশন করেন শিল্পী সুমন চৌধুরী, কল্পনা আনাম ও কমলিকা চক্রবর্তী।

অধ্যাপক ড. বেগম আকতার কামাল বলেন, নজরুল মূলত বিপ্লবের কবি। তিনিই ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যে ভাঙনের গান গেয়েছেন কারণ নতুন সৃষ্টির জন্য ভাঙন প্রয়োজন। তাকে নিয়ে সবসময় রাজনীতি হয়েছে। স্বার্থান্ধ মহল তাকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে চেয়েছে কিন্তু নজরুল কোনো সীমানায় আবদ্ধ হওয়ার মতো কবি নন। তিনি বলেন, বাংলা সাহিত্যে ত্রিশ দশকের কবিদের কেউ কেউ নজরুলকে স্বীকারে উদারতার পরিচয় দেননি। তারা কখনও কখনও নজরুলের আধুনিকতা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন কিন্তু আমরা মনে করি কালধর্মকে নজরুল যে সার্থকভাবে তার সাহিত্যকর্মে ধারণ করে গণচিত্তকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন তাতেই তার আধুনিকতার সূত্রসার নিহিত।

ছায়ানট গান ও কবিতায় নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট।

আসরের শুরুতেই কবিকে নিয়ে পাঠ করেন জহিরুল হক। এরপর সম্মেলক গান ‘এসেছি তব দ্বারে’ গানটি পরিবেশন করেন ছায়ানটের শিল্পীরা। এরপর নজরুলের সাধারণ পর্যায়ের রচিত একটি বন্দনা গীতি পরিবেশন করেন তারা।

একক গান পর্বে ফারহানা আক্তার শ্যার্লি গেয়ে শোনান তোমার মহাবিশ্বে কিছু ‘হারায় না তো কভু’, লায়েকা বশীর শোনান ‘অন্তরে তুমি আছ চিরদিন’, সৈয়দা সনজিদা জোহরা বীথিকা পরিবেশন করেন ‘গগনে প্রলয় মেঘের মেলা’, এরপর সম্মেলক কণ্ঠে নজরুলের ইসলামী গান ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে, গেয়ে শোনান’ ছায়ানটের শিল্পীরা।

ইসলামি গান পর্বে এককভাবে বিজন চন্দ্র মিস্ত্রী শোনান ‘তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত’, খায়রুল আনাম শাকিল ‘আয় মরু পারের হাওয়া’, মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া ‘গুল-বাগিচার বুলবুলি আমি’ রেজাউল করিম অরুণকান্তি ‘কে গো যোগী ভিখারি’ এবং কবির নাতে রাসুল পাঠ করেন জহিরুল হক খান।

সম্মেলক গান পর্বে শিল্পীরা শোনান শঙ্কর অঙ্গলীনা যোগ মায়া, সনাতন গান পর্বে নাহিয়ান দুরদানা শুচি শোনান ‘জয় ব্রহ্ম বিদ্যা শিব-সরস্বতী, শ্রাবন্তী ধর’, শোনান ‘এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন’, মাহমুদুল হাসান ‘তোর কালো রূপ লুকাতে মা’, মনীষ সরকার পরিবেশন করেন ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’, শারমিন সাথী ইসলাম ময়না শোনান ‘শুক-শারি সম তনু মন মম’, সুস্মিতা দেবনাথ শুচি শোনান ‘সজল-কাজল-শ্যামল এসো’, তানভীর আহমেদ পরিবেশন করেন ‘আমি বাউল হলাম ধূলির পথে’। এরপর সম্মেলক গান ‘মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ’ পরিবেশন করেন প্রতিষ্ঠানটির শিল্পীরা। যথারীতি জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ছায়ানটের নজরুল স্মরণ।

আয়োজনে সম্মেলক পরিবেশনায় ছিলেন তানভীর আহমেদ, শরিফুর রহমান, প্রিয়ন্তু দেব, ভাস্কর দেব নাথ, শ্রাবন্তী ধর, নুসরাত জাহান করুনা, নাহিয়ান দুরদানা শুচি, শর্মিষ্ঠা দাশ, মাহ্‌বুবা আলম হৃদী প্রমুখ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App