×

সাহিত্য

সত্যনিষ্ঠতা ছিলো তার জীবনদর্শন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ১০:২৪ পিএম

সত্যনিষ্ঠতা ছিলো তার জীবনদর্শন

সুফিয়া কামাল

সত্যনিষ্ঠতা ছিলো তার জীবনদর্শন। এই সত্যনিষ্ঠতাকে অবলম্বন করে সমাজ কাঠামোয় চলমান বিচারহীনতা, ধর্মান্ধতা, সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করে নারীর পূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

মঙ্গলবার (২০ জুন) বিকালে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কবি সুফিয়া কামালের ১১২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সুফিয়া কামাল ও তরুণ প্রজন্ম’ বিষয়ক স্মারকবক্তৃতা ও সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেমের সভাপতিত্বে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্মারকবক্তৃতা দেন আজকের পত্রিকার ডেপুটি এডিটর জাহীদ রেজা নূর। এ বছর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাষ্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেনকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য সুফিয়া কামাল সম্মাননা এবং উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয়।

এ সময় কবির উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ইফফাত আরা দেওয়ান ও আজিজুর রহমান তুহিন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়। সামন্ত লাল সেনের জীবনী পাঠ করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম। স্মারবকক্তৃতা শেষে বক্তা জাহিদ রেজা নূরকে উত্তরীয় প্রদান করা হয়। শুরুতে সুফিয়া কামালের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট মানবাধিকারনেত্রী সুলতানা কামালসহ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও আগত অতিথিরা। স্মারকবক্তা জাহীদ রেজা নূর বলেন, ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ এর সময়ের তৎকালীন সমাজব্যবস্থার প্রকৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ধর্ম ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব, জাতীয়তাবাদ, পুঁজিবাদ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কবি সুফিয়া কামালের ছিল নিরন্তর সংগ্রাম। এই লড়াইয়ে কবির প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈষম্যমূলক আচরণ ছিল যার বহিঃপ্রকাশ অতীতে ছিলো এখনো ঘটে চলেছে, তবে ভিন্নভাবে।

তিনি বলেন, শুধু নারীর অধিকারই সুফিয়া কামালের ভাবনার জায়গা দখল করে রাখেনি। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে, মননে নারীর প্রতি বৈষম্যের দিকটি সবার কাছে আজ দৃশ্যমান। তিনি একটি বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধতামুক্ত এবং নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন। অন্যদিকে সত্যনিষ্ঠতা ছিলো তার জীবনদর্শন। এই সত্যনিষ্ঠতাকে অবলম্বন করে সমাজ কাঠামোয় চলমান বিচারহীনতা, ধর্মান্ধতা, সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করে নারীর পূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় তরুণ প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

যে সমাজের প্রতি সুফিয়া কামাল বিশ^াস রেখেছিলেন সে সমাজ এখন নড়বড়ে হয়ে গেছে উল্লেখ করে ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, অসাম্প্রদায়িকতা এখন নড়বড়ে হয়ে গেছে। তবে সুফিয়া কামাল আমাদের যা দিয়ে গেছেন চলার পথের অন্ধকার ভেদ করে চলার জন্য তা যথেষ্ট। তিনি বলেন, যতদিন সভ্যতা থাকবে মানবতাও থাকবে। তরুণ সমাজের সংকট বিভ্রান্তিও থাকবে, তবে তারা এসব অতিক্রমও করবে। সুফিয়া কামাল সম্মাননা প্রাপ্তির অভিব্যক্তি জানিয়ে ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, সুফিয়া কামালের মত বড় মাপের ব্যক্তিত্বের নামে এই পুরস্কার প্রাপ্তি আমার জন্য সর্বোচ্চ সম্মানের। তিনি এ সময় চিকিৎসা সেবাদানকালে সহিংসতার শিকার নারীর প্রতি বীভৎসতার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, এসব আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসাসেবাদান অব্যাহত রাখতে বড় পরিসরে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, আজ থেকে ১১১ বছর আগে কবির জন্মলগ্নে নারীদের জন্য সমাজ ছিলো অন্ধাকারাচ্ছন্ন যখন তারা শিক্ষার আলো ও বাইরের জগৎ থেকে অনেক দূরে ছিলো। কিন্তু সুফিয়া কামাল পারিবারিকভাবে শিক্ষার জন্য সহায়তা পেয়েছিলেন ও চারপাশের আলোকিত মানুষদের সান্নিধ্যে এসেছিলেন যা তার মানবিক বিকাশে সহায়তা করে। তিনি নিজেকে একজন নারীবাদী, মানবতাবাদী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তার বোধ তাকে পরিচালিত করেছিলো নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। তিনি সমস্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে তরান্বিত করতে তরুণ সমাজকে সংগঠিত করেছেন, তাদের মধ্যে মুক্তবুদ্ধির চিন্তা চেতনাকে সঞ্চার করেছেন এবং নেতৃত্ব তৈরি করেছেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম।

বাংলা একাডেমির আয়োজন

সুফিয়া কামাল স্মরণে সকালে বাংলা একাডেমি একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাসনা জাহান খানম। একক বক্তৃতা দেন বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির উপপরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়া। ধন্যবাদ জানান বাংলা একাডেমির সচিব মোখলেছুর রহমান আকন্দ। সুলতানা কামাল বলেন, সুফিয়া কামাল তার ব্যক্তিগত জীবনের শোক-দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করে দেশের মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন। এই কাজে তাঁর কোনো বিরতি ছিল না, অবসর ছিল না। তিনি রক্ষণশীলতার দূর্গ ভেঙেছেন, প্রগতির পতাকা উড়িয়েছেন এবং জোর গলায় বলতে চেয়েছেন ‘নিশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প বিকাশের প্রয়োজনে’। সেলিনা হোসেন বলেন, কবি সুফিয়া কামাল কবিতা ও কর্মিতায় এক কোমল-কঠোর নাম। সুফিয়া কামালের কবিতা যেমন মানব-অনুভবের কোমল মহাদেশকে স্পর্শ করে তেমনি তার নারী আন্দোলন, কুসংস্কার-বিরোধী অবস্থান এবং মানবমুক্তির আবাহন কঠোর সত্যের বার্তাবহ। হাসনা জাহান খানম বলেন, সুফিয়া কামাল আমৃত্যু নারী অধিকার, মানবসাম্য এবং আধুনিক সমাজ ও স্বদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে গেছেন। সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি যেমন বাংলা সাহিত্যে নতুন অধ্যায় যোগ করেছেন, তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের সামগ্রিক অগ্রসরমানতা নিশ্চিত করেছেন। সাইমন জাকারিয়া বলেন, সুফিয়া কামাল মানেই প্রগতির পথে, মুক্তির রথে অনন্ত আলোকযাত্রা। প্রতিকূল পরিবেশে মানবমঙ্গলের বিজয়কেতন উড়িয়ে তিনি বাংলার ইতিহাসে জননী সাহসিকা-রূপে স্বরণীয় হয়ে আছেন। মোখলেছুর রহমান আকন্দ বলেন, সুফিয়া কামালের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। নারী অধিকার এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর লড়াই আমাদের চিরকালীন অনুপ্রেরণার উৎস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App