×

সাহিত্য

সংকটে প্রতিরোধ ও অভিযাত্রার প্রেরণা তিনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

সংকটে প্রতিরোধ ও অভিযাত্রার প্রেরণা তিনি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বলে এসেছেন, কেবল ব্রিটিশদের থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলে আমরা উদ্ধার হব না, প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য চাই মনের মুক্তি ও সমাজের পুনর্গঠন। তার আর একটা চিন্তাও বহুখ্যাত: ভারতীয় ঐতিহ্যে পাশ্চাত্য ‘নেশন’-এর ধারণাটা নেই; আমাদের সাবেক জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করেছে ‘সমাজ’। নেশনের কার্যবাহী অবতার স্টেট: ‘য়ুরোপের শক্তির ভাণ্ডার স্টেট অর্থাৎ সরকার; ... আমাদের দেশে কল্যাণশক্তি সমাজের মধ্যে।’

তিনি আরও বলেছেন, পাশ্চাত্যে পাবলিক বলে একটা সত্তা আছে, অর্থাৎ জনসাধারণের সক্রিয় সমবেত রূপ যা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতে তার অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল এক ‘ফাঁকি পবলিক’।

তিনি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ‘শক-হুন পাঠান-মোগল উৎকল-দ্রাবিড়’ সবার মিলনকে স্বাগত জানিয়েছেন, তেমনি আবার অনুপুঙ্খে গিয়ে বুঝেছেন যে জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের অবসান ঘটাতে হবে।

এমনকি ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব প্রবর্তন করে হিন্দু-মুসলিমে সম্প্রীতি ও সান্নিধ্যের সুযোগ তৈরি করতে চাইলেন। নিজে পথে নামলেন, সাধারণ মুসলিম প্রবীণের হাতে রাখি পরালেন, মিছিলের পুরোভাগে থেকে গাইলেন-‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’।

অথচ এখনও রবীন্দ্র বিরোধীতার শেষ নেই। মনের মুক্তি আসল না। সব বিরোধিতা ছাপিয়ে এইখানেই রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা সবার মনোযোগ আকৃষ্ট করে। তার অসামান্য প্রতিভার ফসল কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটকের মতো সৃজনশীল সাহিত্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে প্রাদেশিকতার গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্বদরবারে পৌঁছানোর যোগ্যতা ও মান এনে দিয়েছে। রুচিবিকারে ও ক্ষয়িষ্ণুতায় আক্রান্ত সেকালের নাগরিক গানকে তার সংগীত-স্থূলতার গণ্ডি ভেঙে কেবল পরিশীলনের মুক্তিপথ দেখায়নি, সর্বভারতীয় নাগরিক সংগীতনন্দনের অগ্রবর্তী অবস্থানে উন্নীত করেছে বাংলা সংগীতকে। আর বিভেদ, অবক্ষয়, সংকীর্ণতা, কুসংস্কারসহ নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজকেও তিনি কখনো ত্যাগ করেননি। রোগাক্রান্ত এই সমাজকে তিনি সংস্কারের ও নবায়নের জন্য প্রাণপাত করেছেন। কখনো তীক্ষ সমালোচনায়, কখনো সরস ব্যঙ্গে, কখনো স্পষ্টকথনে, কখনো বা অকাট্য যুক্তির বিন্যাসে এই দুর্বল, ভঙ্গুর, বিভক্ত, কলহপ্রবণ সমাজকে তার সব কলুষ-তামস ভেদ করে উন্নত মানুষ হিসেবে দাঁড়ানোর প্রেরণা দিয়ে ও পথ দেখিয়ে গেছেন।

কবির জন্মদিন প্রথম বার পালিত হয়েছিল তার ২৬ বছর বয়সে, ১৮৮৭ সালে। প্রিয় ভাগ্নী সরলাদেবী ‘জীবনের ঝরাপাতা’য় লিখেছেন, ‘রবিমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই। তখন মেজমামা ও নতুন মামার সঙ্গে তিনি ৮৯ পার্ক স্ট্রিটে থাকেন। অতি ভোরে নিঃশব্দে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধুতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাকে জাগিয়ে দিলাম’, এর পর সে দিন বাড়িতে সবাই মিলে জন্মদিন পালন হয়েছিল। পরে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকেরা ১৯১০ সাল থেকে নিয়মিত কবির জন্মদিন পালন করে এসেছেন। ১৯৩১ সালে কবির ৭০ বছর বয়সে তো রীতিমতো আলোড়ন তুলে রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠান কমিটির সভাপতি ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, মূল উদ্যোক্তা অমল হোম। এই উপলক্ষে প্রকাশিত ‘ঞযব নড়ড়শ ড়ভ ঞধমড়ৎব এড়ষফবহ’- এ নিবন্ধ লিখেছিলেন দেশ, বিদেশের নামী, গুণী মানুষেরা। জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য গ্রহণে কবির অসন্তোষ কখনও বোঝা যায়নি। কিন্তু মনের নিভৃতে কি কবির ভাবনা অন্য খাতে বইত! প্রতি বছর জন্মদিন উপলক্ষে তিনি কিছু লিখতেন। সব কবিতাতেই সেই অনন্ত জিজ্ঞাসা, ‘কে আমি ?’ চিরন্তন এই প্রশ্ন থেকে ‘এই আমি প্রথমজাত অমৃত’ উত্তরে ফেরার চেষ্টা। সে সব কবিতাই আমাদের দলিল দস্তাবেজ। বাংলা ১৩৪৪ সালে আলমোড়াতে বসে ‘জন্মদিন’ কবিতায় লিখছেন, ‘দৃষ্টিজালে জড়ায় ওকে হাজারখানা চোখ,/ ধ্বনির ঝড়ে বিপন্ন ঐ লোক।/ জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে’।

আজ মঙ্গলবার বাঙালির পরম আরাধ্য মহাত্মা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ১৬২তম জন্ম জয়ন্তী। এ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বানীতে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শ ও তার সৃষ্টিকর্ম শোষণ-বঞ্চনামুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে চিরদিন বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করবে। শেখ হাসিনা বলেন ‘কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিনিধি। বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি নির্দেশকের ভূমিকা রেখেছেন। তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত স্রষ্টা। চিত্রকর, সমাজচিন্তক এবং মানবতাবাদী দার্শনিক হিসেবেও রয়েছে তার বিশ্বখ্যাতি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠেছিল প্রেরণার বিশেষ উৎস।’

রবীন্দ্রভূমির এক ভাগ কাব্য আর তিন ভাগ গদ্য। চিন্তা ব্যাখ্যা বাস্তববোধ তার প্রতিভার বুনিয়াদ; সেই মাটি থেকে উঠে আকাশ ছুঁয়েছে তার কল্পনা, ভাবাদর্শ, বিশ্বচেতনা। তার দেবতা মন্দির ছেড়ে মাঠে চাষ করেন, রাস্তার ধারে পাথর ভাঙেন। শেষ অবধি দেবতার মধ্যস্থতা লাগে না, কবি নিজেই পৌঁছে যান সেই পরম বাস্তব মানসলোকে: ‘মাটির পৃথিবীপানে আঁখি মেলি যবে/ দেখি সেথা কলকলরবে/ বিপুল জনতা চলে/ নানা পথে নানা দলে দলে/ যুগযুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে/ জীবনে মরণে।’

জীবন ও জগৎ বেদনার আলোয় কবির চিত্তে উদ্ভাসিত হয়ে সত্যের সুন্দর ভাষ্য রচনা করেছে সংগীতে। কত অসাধারণ সব গান রচনা করেছেন তিনি!

এখানে বলা দরকার রবীন্দ্রসংগীতের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা। দেখা গেল সাধারণ মানুষ, যার জীবন হতদরিদ্রের নিঃস্বতায় জর্জরিত নয়, একটুখানি মানবিক সুবাতাস গ্রহণের সামান্য অবকাশটুকু আছে, সে যেন রবীন্দ্রনাথের গানে ঠিকই তার মনের পুষ্টি পেয়ে যায়। বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় যে বলেন, ‘বাংলার পথে, ঘাটে, হাটে, মাঠে, এমনকি সুদূর নিভৃত পল্লির ঘরে প্রাঙ্গণে তাহার গানের সুর বাজিয়া উঠিতেছে।’ কারণ তিনি জানেন, ‘রবীন্দ্রনাথ খাঁটি বাঙালি কবি। রবীন্দ্রনাথের যে সত্যকার কবি-মূর্তি, তাহা সেই বাংলার বৈষ্ণব কবিরই প্রতিচ্ছবি। ...তাহার প্রেম ও ধর্মবিষয়ক সংগীতগুলিতে বৈষ্ণবভাব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় নাই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা’, যা সাধারণের অতি পরিচিত। অধিকাংশ গানের সুরও তাদের নিতান্ত ঘরের জিনিস। আর যেসব গানে স্বদেশি ভাবকে আবেগে ও তেজে রূপ দিয়েছেন, তা যেকোনো বাঙালির মনে দেশপ্রেমের উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। যেসব গানে মানবমুক্তির প্রতিজ্ঞা নানাভাবে ব্যক্ত হয়েছে, সেগুলোতেও সংকটকালে প্রতিরোধ ও অভিযাত্রার প্রেরণা পাওয়া যায়। এভাবে ষাটের দশকে বাঙালির জাতীয়তাবাদী জাগরণ, আত্মবিকাশ ও রাষ্ট্রসাধনায় রবীন্দ্রনাথ তার বড় সহায়রূপে পথের দিশারি হয়ে ওঠেন।’

কর্মসূচি: কবিগুরুর জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ছায়ানট দুইদিনব্যাপী রবীন্দ্র-উৎসবের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে সন্ধ্যা ৭টায়। দুইদিনব্যাপী এই উৎসবে পরিবেশিত হবে একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন। ছায়ানট মিলনায়তনে আয়োজিত এই উৎসব সকলের জন্য উন্মুক্ত। একই সাথে অনুষ্ঠানটি ছায়ানটের ফেইসবুক পেইজে (ভধপবনড়ড়শ.পড়স/পযযধুধহধঁঃ১৯৬১) সরাসরি অনলাইনে দেখা যাবে।

এছাড়া জাতীয় পর্যায়ে পতিসর, ঢাকা, শিলাইদহ, শাহজাদপুর, দক্ষিণডিহি, পিঠাভোগে একযোগে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা, চ্যানেল আই, প্রাঙ্গণের মোড়সহ সরকারিভাবে নানা অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App