×

আন্তর্জাতিক

ভারতের স্টোর ম্যানেজার রাশিয়ার যোদ্ধা হয়ে ইউক্রেনে নিহত

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৪২ পিএম

ভারতের স্টোর ম্যানেজার রাশিয়ার যোদ্ধা হয়ে ইউক্রেনে নিহত

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের হায়দরাবাদের ৩১ বছরের তরুণ আসফান মোহাম্মদ নিজের এবং পরিবারের উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন। একটি কাপড়ের দোকানের স্টোর ম্যানেজার আসফানের স্বপ্ন ছিল অস্ট্রেলিয়া পাড়ি জমানো।

কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি। কারণ, রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেইনে যুদ্ধ করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছেন দুই সন্তানের জনক (২ বছর আর সাত মাস) আসফান।

গত মার্চ মাসের শেষ দিকে এক রবিবার একটি কফিন আসে আসফানদের হায়দরাবাদের বাড়িতে। প্রায় ৪ মাস আগে রাশিয়া যাওয়ার পর সেই প্রথম তার পরিবার তাকে সামনা সামনি দেখতে পায়।

আসফানের ভাই ইমরান সিএনএনকে বলেন, ‘আমি তার কাঁধ এবং পুরো পিঠজুড়ে গুলির গর্ত দেখতে পাই। মোট ছয় বা সাতটি গর্ত। সে ড্রোন হামলার শিকার হয়েছিল। সেটি তার শরীর ছিদ্র করে ফেলে। অভ্যন্তরীণ ক্ষতও ছিল। তার দুইটি দাঁত ভাঙা ছিল।’

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেইনে আক্রমণ করে তখন আসফানের পরিবার কল্পনাও করতে পারেনি তাদের বাড়ির ছেলেকে দুর্ভাগ্যজনক এ পরিণতি বরণ করতে হবে।

ওই সময় নিজের শহরে পোশাক ব্রান্ড অ্যালেন সোলির চেইন শপে স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলেন আসফান। তিনি আট বছর ধরে সেখানে চাকরি করতেন বলে জানান তার বড় ভাই ইমরান।

ইমরান বলেন, ‘তার চাকরিটা খারাপ ছিল না। কিন্তু স্ত্রী ও বাচ্চাদের জন্য আরো বেশি কিছু করতে চেয়েছিল আসফান। তার স্বপ্ন ছিল তাদের হায়দরাবাদের বাইরে নিয়ে যাওয়ার।

‘সে অস্ট্রেলিয়ায় যেতে চেয়েছিল। আসফানের স্ত্রীর বোন এবং তার পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। তারা তাদের সেখানে যেতে বলেছিল। কিন্তু সেজন্য আইএলটিএস এ অনেক বেশি স্কোর করার প্রয়োজন ছিল।’

আসফান আইইএলটিএস পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু ভালো করতে পারেনি।

ইমরান বলেন, ‘সে হতাশ হয়ে পড়েছিল। বারাবার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হওয়ার পর ওই সময়ে ইউটিউবে ভিডিওর মাধ্যমে আসফান রাশিয়ার কর্মসংস্থানের সুযোগের কথা জানতে পারে। সে রাশিয়ার একটি বিদেশি শ্রমিক নিয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে।

কয়েকদিন পর তারা জানায়, রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে সহায়তাকারী এবং নিরাপত্তারক্ষীর কিছু পদ খালি হয়েছে। নিয়োগকারী সংস্থা তাকে বলেছিল, এটা তার জন্য সেরা সুযোগ। বলেছিল, এক বছরের মধ্যে সে রাশিয়ার পাসপোর্ট এবং পরিচয় পত্র পেয়ে যাবে এবং সেগুলো নিয়ে প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে চলে যেতে পারবে।

আসফান রাশিয়ায় যাওয়াকে তার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে একটি সিঁড়ি বলে মনে করেছিল বলে জানান তার ভাই। বলেন, আসফান তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে তার পরিকল্পনার কথা গোপন করেছিল। গত বছর ৯ নভেম্বর আসফান রাশিয়া রওয়ানা হন। তার মাত্র ৩ দিন আগে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন বলে জানান ইমরান।

ততদিনে আসফান রাশিয়ার যেতে নিয়োগকারী সংস্থাকে ১৮ শত ডলারের বেশি দিয়ে দিয়েছে। তারা আসফানকে তার রাশিয়া যাওয়ার বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে বলেছিল। এমনকি পরিবারকেও না।

ইমরান বলেন, ‘ওরা তার মগজ পুরোপুরি ধোলাই করে ফেলেছিল। তারা আসফানকে সতর্ক করে বলেছিল, যদি সে মুখ খোলে তবে রাশিয়া থেকে, বিমানবন্দর থেকেই তাকে বিতাড়িত করা হবে। আমি তাকে থামাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম।’

একাধিকবার বিরতি দিয়ে ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য নাগরিকদের সঙ্গে ১২ নভেম্বর মস্কো পৌঁছান আসফান।

একদিন পর সে কাগজপত্র সই করে, সেগুলো সব রুশ ভাষায় লেখা ছিল। তাই সে কিছুই পড়তে পারেনি। সে নিয়োগকারীদের অন্ধের মত বিশ্বাস করে ফেলেছিল।

আক্রমণের পর থেকেই হাজারো বিদেশি যোদ্ধাকে রাশিয়া নিজেদের হয়ে যুদ্ধ করতে ইউক্রেইনে পাঠিয়েছে। তাদের অনেককেই স্থায়ী কাজ এবং উচ্চ বেতনের লোভ দেখিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে নেয়া হয়েছে।

নেপালের স্বনামধন্য বিরোধীদলের নেতা এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিমলা রাই পাউদ্যাল এ বছরের শুরুতে দেশটির পার্লামেন্টে বলেছিলেন, ইউক্রেইনের যুদ্ধক্ষেত্রে ১৪ হাজার থেকে ১৫ হাজার নেপালি যুদ্ধ করছেন। ইউক্রেইন থেকে ফিরে এসেছেন এমন নেপালিদের বরাত দিয়ে তিনি ওই তথ্য দেন।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেইন যুদ্ধে সেনা সংকটে ভুগছে রাশিয়া। যে কারণ দেশটি গত বছর বিদেশি সেনাদের তার দেশের হয়ে যুদ্ধ করতে লোভনীয় প্যাকেজের ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যেখানে প্রতিমাসে অন্তত ২০০০ ডলার বেতন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে দ্রুত রাশিয়ার নাগরিকত্ব প্রদান। এই পরিকল্পনার অধিনে তারা কত বিদেশি যোদ্ধা নিয়োগ দিয়েছে সে বিষয়ে ক্রেমলিন কোনো রকম তথ্যই দেয়নি।

স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে দিল্লির গভীর মিত্রতার সম্পর্ক। ইউক্রেনে আক্রমণ নিয়ে এখন পর্যন্ত দিল্লি রাশিয়ার নিন্দা জানায়নি। তাছাড়া ভারতে অস্ত্রের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা দেশও রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত বরং নিজেদের স্বার্থ দেখেছে। দেশটি রাশিয়া থেকে কম দামে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল কিনেছে।

রাশিয়ার তেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমারা দেশটির অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে দেয়ার যে চেষ্টা করেছিল ভারতের কারণে তা হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধাবস্থায় রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা দেশের অন্যতম ভারত।

এদিকে, ভারতে এমন কোনো আইনও নেই যেটি দেশটির নাগরিকদের বিদেশি কোনো সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা আটকাতে পারে। ভারত সরকার খুব ভালো করেই জানে যে, দেশটির অনেক নাগরিক ইউক্রেইনে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, রাশিয়ার সেনাবাহিনী থেকে ভারতীয় যোদ্ধাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বের করে নিয়ে আসার জন্য তারা ‘অগ্রাধিকার ভিত্তিতে’ কাজ করছে।

এজন্য তারা রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছেন বলেও গত মাসে সিএনএন কে বলেছিলেন তারা।

মার্চের শুরুতে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) থেকে বলা হয়, তারা মানব পাচারকারীদের বড় চক্র চিহ্নিত করেছে। যারা ভারতীয়দের রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে চাকরির লোভ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তারা এ ধরণের ৩৫টি ঘটনা জানতে পেরেছে।

ইমরান বলেন, কবে ইউক্রেইন পাঠানো হয়েছে সে বিষয়ে তার ভাই তাকে কিছু জানাননি। তবে গত ১ ডিসেম্বর থেকে তিনি আর তার ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

ইমরান জানান, গত ২৩ জানুয়ারি তিনি একটি ভয়েস ম্যাসেজ পান। আসফানের সঙ্গে অন্য যে ভারতীয়রা যুদ্ধ করছে তাদের একজন সেটা পাঠান।

ওই ব্যক্তি ইমরানকে জানান, তিনি যুদ্ধে আহত হয়েছেন। ইউক্রেইনে একটি বাড়িতে আহত অবস্থায় তিনি আসফানকে দেখতে পান।

ওই ব্যক্তি আমাকে আরও বলেন, চারিদিকে ড্রোন ঘোরাঘুরি করছে। তাই তিনি তার ভাইকে নিয়ে সরে যেতে পারছেন না। তবে তিনি রাশিয়ার একটি মেডিকেল দলকে আসফানের আহত অবস্থার বিষয়ে জানিয়েছেন।

দুইদিন পর ইমরান তার আহত ভাইকে সহায়তার আবেদন নিয়ে তাদের এলাকার এমপির কাছে যান। কিন্তু সরকার থেকে তাকে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।

মস্কোতে ভারতীয় দূতাবাস থেকে বলা হয়েছিল, তারা বিষয়টি দেখছেন।

গত ৬ মার্চ এমপির কার্যালয়ে গিয়ে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পান ইমরান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App