×

আন্তর্জাতিক

পুলিশ হেফাজতে ও হাসপাতালে ধর্ষণের শিকার বহু নারী

Icon

বিবিসি

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:৩৯ পিএম

পুলিশ হেফাজতে ও হাসপাতালে ধর্ষণের শিকার বহু নারী

ভারতে ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে, হাসপাতালে বা রিমান্ড হোমে থাকাকালীন অন্তত ২৭৫ জন নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে বলে সরকারি পরিসংখ্যানেই জানানো হয়েছে। সম্প্রতি ‘কাস্টডিয়াল রেপ’ বা হেফাজতে থাকাকালীন (ওই ছয় বছরে নথিভুক্ত হওয়া) ধর্ষণের ঘটনার এই তথ্য প্রকাশ করেছে ভারতের ন্যাানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, হেফাজতে থাকাকালীন সব চেয়ে বেশি ধর্ষণের অভিযোগ ভারতের যে রাজ্য থেকে মিলেছে সেটি হল উত্তরপ্রদেশ, আর তার পরেই রয়েছে মধ্যপ্রদেশ।

উল্লিখিত, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পুলিশি হেফাজতে, জেলে, হাসপাতালে, রিমান্ড হোম-সহ ‘হেফাজতে থাকাকালীন’ মোট ৯২টি ধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে এবং ৪৩টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে মধ্যপ্রদেশে। এই পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসার পরই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনজীবী, মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য এবং সমাজকর্মীরা।

প্রবীণ সমাজকর্মী শবনম হাশমি বলেছেন, “নারীদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। নারীদের দাবিয়ে রাখতে ধর্ষণকে মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা হেফাজতে থাকাকালীন হোক বা বাইরে। তবে শুধু ধর্ষণ নয়, যারা অভিযুক্ত তাদের আড়াল করার যে ঘটনা আমরা একের পর এক দেখে আসছি তাও কিন্তু বাড়ছে।

কী বলছে ওই পরিসংখ্যান?

সম্প্রতি ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো ‘কাস্টডিয়াল রেপ’ বা পুলিশি হেফাজত, হাসপাতাল, সেফ হোমের মতো স্থানে নারীদের ধর্ষণের ঘটনার একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ৩৭৬ (২) ধারা অনুযায়ী ওই ধর্ষণের অভিযোগগুলি দায়ের করা হয়েছিল। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৬ (২) ধারা তখনই লাগু করা হয় যদি ধর্ষণে অভিযুক্তরা পুলিশ কর্মী, জেলের কর্মী, সেনা কর্মকর্তা, হাসপাতালের কর্মী, হোমের আধিকারিক বা অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ হন।

হেফাজতে থাকা নারীদের সুরক্ষার দায়িত্ব ওই সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথা কর্মীদেরই। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য বলছে হেফাজতে থাকাকালীন ২০২২ সালে ২৪টি মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ২০২১ সালে ২৬টি, ২০২০ সালে ২৯টি, ২০১৯ সালে ৪৭টি, ২০১৮ সালে ৬০টি এবং ২০১৭ সালে ৮৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্যের নিরিখে ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ২০১৭ এর তুলনায় কমলেও ‘হেফাজতে’ থাকা অবস্থায় ‘নিরাপত্তা’ যে প্রশ্নের মুখে সে বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছেন মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী ও অ্যাক্টিভিস্টরা।

প্রসঙ্গত, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশ দু’টি রাজ্যই বিজেপি শাসিত।

সরব অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা

অধিকার আন্দোলনের কর্মী আলতাফ আহমেদ বলেন, “এটা একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা। একজন নারী যিনি কারাগারে বন্দি, হাসপাতালে রয়েছেন বা হোমে আছেন, তার সুরক্ষার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। যে মুহূর্তে আমি পুলিশ বা জেলের হেফাজতে আছি, সেই সময় থেকেই সমস্ত দায়দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর প্রতিবেদনে যে সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে তা দায়ের হওয়া ঘটনার অন্তর্ভুক্ত। দায়ের হয় না এমন অভিযোগের সংখ্যা বহু বলেই অ্যাক্টিভিস্টরা জানাচ্ছেন।

আলতাফ আহমেদ মনে করেন, হেফাজতে থাকাকালীন নারীদের উপর এই অপরাধের ঘটনা এক ধরনের ‘দমননীতি'ও। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে উঠে আসে উত্তরপ্রদেশের হাথরাস এবং পশ্চিমবঙ্গের কামদুনির ধর্ষণের ঘটনার প্রসঙ্গও। নারীদের উপর অত্যাচার করাটা তাদের দাবিয়ে রাখারও একটা পদ্ধতি। যেন একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করা যে অমুক কাজটা করলে কামদুনি বা হাথরাসের মতো ঘটনা হবে বলে চোখ রাঙানি -এগুলো তো আমরা বাইরে শুনি। শাসকদল, মাফিয়া যে ভাষায় কথা বলে রাষ্ট্রও যদি একই ভাষায় কথা বলে তা হলে সেটা খুবই্ ভয়ের। যার হেফাজতে কাউকে রাখা হল সে-ই নির্যাতন করছে,” বলছিলেন মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর কর্মী আলতাফ আহমেদ।

বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সম্পাদক কিরীটি রায় বলেন, “জেলকে তো সংশোধনাগারে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে যদিও তা পালন করা হয় না। সেখানে সবাইকে অপরাধী বলেই দেখা হয় এবং সেখানে অপরাধই ঘটে। এবং এই সিস্টেমের মধ্যে যারা আছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। আর সমাজে নারীদের ভোগ্যপণ্য হিসাবেই দেখা হয়”, বলছিলেন তিনি।

তার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে রায় জানিয়েছেন, জেলে, থানায় বা অন্যত্র হেফাজতে থাকাকালীন এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়।তার কথায়, “আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এই ঘটনা প্রায়শই ঘটে। পুলিশের হাতেও যেমন ঘটে, একই ভাবে জেলের অন্য আবাসিকদের দ্বারাও নারী বন্দিরা নির্যাতিত হন। অভিযুক্তরা জেলে আসার আগে যে শারীরিক পরীক্ষা হওয়ার কথা সেটা হয় না। থানা, লকআপ, আদালতে যাওয়া-আসার পথে এবং জেলে বন্দিদের সঙ্গে নির্যাতন হয়। আর অভিযুক্ত যদি নারী হন, তা হলে তো আরও মারাত্মক হয়। এই পুরোটাই হচ্ছে হেফাজতে থাকাকালীন। এবং চিত্রটা সমগ্র দেশের। 

‘এই পরিসংখ্যানে অবাক নই'

এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গুজরাট দাঙ্গার সময় বিলকিস বানোর গণধর্ষণ এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনায় অভিযুক্তদের জেলে ফেরত যাওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, তার উল্লেখ করেছেন সমাজকর্মী শবনম হাশমি। তিনি বলেন, “ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনার পর অভিযুক্তদের বিচার হল, সাজা হল সেটা এক, আর সরকার তাকে আড়াল করছে, বাঁচানোর চেষ্টা করছে সেটা আরেক। একই ঘটনা আমরা দেখেছি হাথরাসের ক্ষেত্রে এবং বিলকিস বানোর মামলাতেও।”

“অভিযুক্তদের শুধুমাত্র সাজাই মকুব করে দেয়া হয়নি তাদের সংবর্ধনাও দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্র যদি অভিযুক্তদের সঙ্গে হাত মেলায় তাহলে তারা (অভিযুক্ত) আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এটা পুরো ভারতের চিত্র। উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশেও একই ছবি ফুটে উঠেছে। দুই রাজ্যেই একই সরকার ক্ষমতায়।তাই এই পরিসংখ্যান খুবই পীড়াদায়ক কিন্তু এসব আমাকে আর অবাক করে না”, বলছিলেন শবনম হাশমি।

হাসপাতাল বা রিমান্ড হোমের মতো স্থানেও একাধিক ধর্ষণের ঘটনা ওই পরিসংখ্যানে রয়েছে। সে বিষয়ে তিনি বলেন, “আসলে নারীকে একটা নির্দিষ্ট ভাবেই দেখা হয়, সেটা যেখানেই হোক। এবং নারীদের অবস্থান সমাজে উত্তরোত্তর নীচে নামছে। সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন ছাড়া তাদের আর কিছুই ভাবা হয় না। সম্মানের সঙ্গে তাদের প্রতি আচরণ করা হয় না। লিঙ্গ সমতাও নেই।”

তার মতে নারী নির্যাতনের ঘটনা যে আগে ঘটত না তেমনটা নয়, তবে রাষ্ট্র তাকে এখন 'প্রশ্রয়' দিচ্ছে সেটা সচরাচর দেখা যেত না। বছর দশেক আগে যে এমনটা ঘটত না তা নয়। তবে, রাষ্ট্র তাকে প্রশয় দিচ্ছে সেটা এভাবে প্রকাশ্যে দেখা যেত না। ঘটনার নৃশংসতা এবং সংখ্যা বেড়েছে সেটা নিঃসন্দেহে ঠিক। আরো দুঃখের বিষয় হল এই জাতীয় অপরাধ যে কোনও জায়গায় দেখা যাচ্ছে ইদানীং, তা সে হাসপাতালে হোক, পুলিশ বা জেল হেফাজত হোক বা রাস্তাঘাটে। তার কারণ রাষ্ট্র এতে মদত দিচ্ছে,” বলছেন মানবাধিকার কর্মী শবনম হাশমি।

‘এই ঘটনা নতুন নয়’

সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে রাজ্যগুলিতে কারাগারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার পর ‘অ্যামিকাস কিউরি' বা আদালত বন্ধু হিসাবে নিযুক্ত আইনজীবী তাপস ভঞ্জ কলকাতা হাইকোর্টে একটি প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন কারাগারগুলিতে থাকাকালীন নারী বন্দিরা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ছেন এবং কারাগারেই তাদের সন্তানরা জন্ম নিচ্ছে। গত বছর পহেলা এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬ জন শিশু মায়ের সঙ্গে সংশোধনাগারে রয়েছে।

নারী বন্দিদের নির্যাতনের ব্যাপারে রিপোর্ট আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এ জাতীয় ঘটনা এড়াতে কারাগারে পুরুষ কর্মীর প্রবেশ নিষেধ, জেলে প্রবেশের সময় প্রেগনেন্সি টেস্ট-সহ একাধিক সুপারিশও করেছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গের কারামন্ত্রী অখিল গিরি অবশ্য জেলে নারী বন্দিদের সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। প্রতিবেদন প্রকাশ্যে আসার পরিসংখ্যান দেখে এই মামলাটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রহণ করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি আহসানুদ্দিন আমানুল্লাহের বেঞ্চ।

সুপ্রিম কোর্টের আদালত-বান্ধব প্রবীণ আইনজীবী গৌরব আগরওয়াল শীর্ষ আদালতকে জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলারা সংশোধনাগারে আসার আগেই অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বা প্যারোলে বাইরে গিয়ে সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর ফেরেন। দেশের সমস্ত কারাগারে নারী বন্দিদের পরিস্থিতির বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেছে শীর্ষ আদালত।

অন্যদিকে, কলকাতা হাইকোর্টে এই প্রতিবেদন পেশ করার পর দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি টি এস গণনম। বিষয়টি ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিচারপতি জয়মাল্য বাগচীর ডিভিশন বেঞ্চে পাঠানো হয়েছে এবং আগামী আটই মার্চ এই মামলার পরবর্তী শুনানি।

ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান প্রকাশ হওয়ার পর আইনজীবী তাপস ভঞ্জ বলেন, “এই ঘটনা তো নতুন নয়। পুলিশি বা জেল হেফাজতে থাকাকালীন যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ হতে পারে হয় থানায়, প্রিজন ভ্যানে যাতায়াত বা কারাগারে থাকাকালীন। কিন্তু ঘটনা সামনে এলে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দুষবে। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি একটি পুরনো ঘটনার উল্লেখ করেন ওই প্রবীণ আইনজীবী।

তিনি জানান,  ২০০২ সালে মূক ও বধির একটি মেয়েকে প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে যখন তাকে ফেরত আনা হয়, জেল সুপার লক্ষ্য করেন তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং আলিপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। শেষ পর্যন্ত ওই অভিযুক্ত পুলিশরা বছর আটেক জেলে থাকার পর খালাস পেয়ে যায়। তারা বলে প্রিজন ভ্যানে নয়, কারাগারেই ওই মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। আসলে কোথায় এই ঘটনা ঘটছে সেটা প্রমাণ করাটা খুব কঠিন। আসলে সবাই নিজের ঘাড় থেকে দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চায়। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App