×

আন্তর্জাতিক

শান্তিনিকেতনকে মানতে হবে যেসব বিধিনিষেধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:১৯ পিএম

শান্তিনিকেতনকে মানতে হবে যেসব বিধিনিষেধ

ছবি: সংগৃহীত

এবার ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে ভারতের শহর শান্তিনিকেতন। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র হিসাবে ঘোষিত হওয়ার পর বেশ কিছু বিধিনিষেধ বা নিয়মকানুনের চাপে পড়তে হল শান্তিনিকেতনকেও। শান্তিনিকেতন বললে একটা বিস্তৃত পরিসর বোঝায়, যা মূল শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়েও চার পাশে অনেকটা ছড়িয়ে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির পরিসর সেই বিরাট শান্তিনিকেতনের কিছু নির্দিষ্ট অংশ। কী কী পড়ছে সেই ঐতিহ্যক্ষেত্রে? ইউনেস্কো যে এলাকা ঠিক করে দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে- আশ্রম ভবন, কলা ভবন, সঙ্গীত ভবন, উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণের মধ্যেই রয়েছে- রবীন্দ্রনাথের বাসগৃহ উদয়ন, উদীচী, শ্যামলী, পুনশ্চ, কোনার্ক। এছাড়াও উপাসনা গৃহ, ছাতিমতলা সবই ঐতিহ্যের তালিকায়। মুক্ত বিদ্যালয় বসে যে সব জায়গায়, তা-ও এই ক্ষেত্রের মধ্যেই পড়ছে। শান্তিনিকেতনের এই স্বীকৃতি পাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে- বহু কালের লড়াই। বহু চেষ্টা। বহু মানুষের উদ্যোগ। তাঁদের মধ্যেই একজন সংরক্ষণ-স্থপতি মণীশ চক্রবর্তী। কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে শান্তিনিকেতনকে আনন্দবাজার অনলাইনকে তা জানালেন মণীশ। তাঁর কথায়, ‘‘শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য যেমন ছুঁয়ে দেখার, তেমন অনুভবেরও। সেখানে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ও দর্শন যেমন ছড়িয়ে রয়েছে, তেমনই তাঁর নিজের এবং সহযোগীদের সৃষ্টি রয়েছে। সেটা যেমন কোনও ভবন, তেমনই ভবনের অন্দরসজ্জাও। আবার যেসব গাছ, বাগান, জলাশয় রয়েছে সেগুলোও ঐতিহ্যের মধ্যে। সবটাই যেমন ছিল, যেমন রয়েছে, তেমন ভাবেই সংরক্ষণ করতে হবে। কোনও বদল আনা যাবে না।’’ মণীশ আরো জানান, ‘‘একবিংশ শতাব্দীর স্থাপত্য রয়েছে এসব ভবনে। যেখানে জাপান, চিন, বর্মার মতো দেশের স্থাপত্যের চর্চা হয়েছে। আবার শান্তিনিকেতনের ইট-কাঠ-পাথরে অথবা গাছের প্রতিটি পাতায় জড়িয়ে রয়েছে কবিগুরুর দর্শন। আমরা এগুলোই ইউনেস্কোকে জানিয়েছিলাম। এখন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হয়ে গেল এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা।’’ মণীশ জানিয়েছেন, মৌলিক কাঠামো (অথেন্টিসিটি) বজায় রেখে এ সবের সংরক্ষণ করতে হবে। জানলা, দরজা কিছু মেরামত করতে হলে তাতে কোনও বদল আনা যাবে না। নকশার তো নয়ই, যা দিয়ে তৈরি তাতেও বদল নয়। কোনও গাছ বদলে দেয়া যাবে না। এমনকি কোনও অনুষ্ঠানে কেমন ভাবে আলপনা দেওয়া হবে, কেমন করে শঙ্খ বাজানো হবে, তাতেও শান্তিনিকেতনের বিশুদ্ধতা (ইন্টিগ্রিটি) মেনে চলতে হবে। এই এলাকায় কোনও নতুন নির্মাণও চলবে না। মূল এলাকার বাইরের যে অংশ, অর্থাৎ বিশ্বভারতীর অধীনস্থ বাকি এলাকায় কিছু ছাড় রয়েছে। এই এলাকায় মূলত রয়েছে খেলার মাঠ, পড়ুয়াদের হোস্টেল। সেখানে আগামী দিনে প্রয়োজনে নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে কেমন হবে সেই নির্মাণ, তা-ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এর জন্য নতুন কমিটি তৈরি করতে হতে পারে বিশ্বভারতীকে। যা খুশি করা যাবে না। প্রয়োজনীয় উন্নয়ন করতে হবে ঐতিহ্য মেনে। ঐতিহ্যশালী স্থাপত্যের কোনও ক্ষতি হয়, এলাকাকে এমন দূষণ থেকে দূরে রাখার ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। এর জন্য যানবাহন নিয়ন্ত্রণের কথাও বলে দিয়েছে ইউনেস্কো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ সালের ১৯ ফেব্রিয়ারি গান্ধীজিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ‘মহাত্মাজি’ সম্বোধন করে শান্তিনিকেতনকে রক্ষার আর্জি জানিয়েছিলেন। চেয়েছিলেন, তাঁর গোটা জীবনের আহরণ, সঞ্চয় যেন সুরক্ষা পায়। গান্ধীজি পত্রপাঠ জবাবে ‘গুরুদেব’কে জানিয়েছিলেন, বিশ্বভারতী শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। কথা দিয়েছিলেন তাঁর সামর্থ মতো চেষ্টা করার। ১৯৪০ সালের সেই পত্রালাপের কথা ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে মনে করাচ্ছেন শান্তিনিকেতনকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভূক্ত করার লড়াইয়ের সৈনিকেরা। বলছেন, এ বার স্থায়ী সংরক্ষণের সুবিধা মিলবে। রবিবারই মিলেছে সুখবর। সৌদি আরবের রিয়াধে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় শান্তিনিকেতনের স্বীকৃতি ঘোষণা হয়েছে। এখন থেকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র হিসাবে স্বীকৃত বাংলার শান্তিনিকেতন। শান্তিনিকেতনের বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পাওয়ার লড়াই কম দীর্ঘ নয়। প্রায় দু’দশক ধরে চলেছে আবেদন, নিবেদন। চলেছে আইন-আদালতও। বড় আকারে যুদ্ধটা শুরু হয় ২০১০ সালে। সেটাও শেষে ভেস্তে যায়। ২০২১ সালে নতুন করে যে উদ্যোগ, তাতেই এল সাফল্য। একটা সময়ে চাওয়া হয়েছিল গোটা শান্তিনিকেতন শহরই আসুক ঐতিহ্যের তালিকায়। তবে তা হয়নি। এবার ইউনেস্কো চিহ্নিত করে দিয়েছে কোন এলাকাকে হেরিটেজ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে- আশ্রম এলাকা, উত্তরায়ণ, কলা ভবন এবং সঙ্গীত ভবন। এখানে রয়েছে ৩৬ হেক্টর জমি (নমিনেটেড প্রপার্টি)। এর বাইরেও একটা বর্ধিত অংশ (বাফার জোন) রয়েছে। ইউনেস্কো জানিয়েছে, সবটা মিলিয়ে ৫৩৭ দশমিক ৭৩ একর এলাকাই বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভূক্ত। শান্তিনিকেতনের এই মর্যাদাপ্রাপ্তির লড়াইটা শুরু হয়েছিল ২০০৩ সাল নাগাদ। এরপরে ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সেই সময়ে মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যোগেন চৌধুরী, মৃণাল সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেবসেন-সহ অনেক বিশিষ্টেরই সমর্থন ছিল। তখনকার কাহিনি শোনালেন এই লড়াইয়ের অন্যতম সৈনিক বিজ্ঞানী পার্থসারথি ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘সেই সময়ে শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ (এসএসডিএ) ও একটি বেসরকারি সংস্থা যৌথভাবে শান্তিনিকেতনের পূর্বপল্লির পাশে ৯ একর জমিতে আবাসন প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সঙ্গে সঙ্গেই শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য রক্ষার লড়াই শুরু হয়।’’

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App