×

আন্তর্জাতিক

প্রিগোশিনের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, নাকি প্রতিশোধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০১:৩৮ এএম

প্রিগোশিনের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, নাকি প্রতিশোধ

ইয়েভগেনি প্রিগোশিন

বিমান দুর্ঘটনায় রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাবাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিমান দুর্ঘটনা কীভাবে হলো, কারণইবা কী- এসব প্রশ্ন সামনে চলে আসছে। রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রিগোশিনের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ঠিক দুই মাস পর এই দুর্ঘটনা ঘটল।

যুদ্ধে নৃশংস উপায় অবলম্বন এবং ইউক্রেন যুদ্ধে সাফল্যের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিলেন যুদ্ধবাজ প্রিগোশিন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মিত্রদের একজন ছিলেন তিনি। ২০২২ সালে রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পর প্রিগোশিনের বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ওয়াগনার গ্রুপ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চলতি বছরের জুনে রাশিয়ার সামরিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রিগোশিন তার সেনাদের মস্কো যাওয়ার নির্দেশ দেন, এতে পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক নেতাদের নেয়া কৌশলে তিনি বিরক্ত ছিলেন, এই বিরক্তিই তাকে বিদ্রোহের পথে নিয়ে যায়। প্রিগোশিনের ওই বিদ্রোহ ২৪ ঘণ্টারও কম সময় ধরে চলেছিল।

স্বল্পস্থায়ী ওই বিদ্রোহের পর থেকে প্রিগোশিন প্রচার-প্রচারণা এড়িয়ে চলছিলেন। বিদ্রোহ শেষ করতে করা চুক্তি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে নেয়া হয় এবং তিনি বেলারুশে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। জুলাইয়ের মাঝামাঝি টেলিগ্রাম চ্যানেলে আসা এক ভিডিওতে দেখা যায়, প্রিগোশিন তার যোদ্ধাদের বেলারুশে স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু ওই মাসেরই শেষ দিকে, তাকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলন চলাকালে দেখা যায়। গত সপ্তাহেও এক ভিডিওতে তাকে দেখা যায়, তাতে তিনি আফ্রিকায় আছেন বলে ধারণা দেন।

গত বুধবার আকস্মিক খবর আসে, ইয়েভগেনি প্রিগোশিন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন। এমব্রায়ার (ইএমবিআর৩.এসএ) লিগ্যাসি এক্সিকিউটিভ জেট বিমানে করে মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে যাচ্ছিলেন প্রিগোশিনসহ মোট ১০ আরোহী। রাডারের তথ্য থেকে জানা গেছে, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার ৩০ সেকেন্ড আগেও এতে কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। হঠাৎ করেই এটি খাড়াখাড়িভাবে মাটিতে আছড়ে পড়ে। রাশিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্মকর্তারা জানান, এমব্রায়ার লিগ্যাসি বিমানটি মস্কো থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গ যাওয়ার পথে বুধবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় মস্কোর উত্তরে তিভিয়ের অঞ্চলের কুশিওনকেনা গ্রামে বিধ্বস্ত হয়েছে।

ফ্লাইটরাডার২৪-এর ইয়ান পেটচিনিক বলেন, গ্রিনিচ মান সময় দুপুর ৩টা ১৯ মিনিটে বিমানটি বিধ্বস্তের ৩০ সেকেন্ড আগে ‘হঠাৎ খাড়াখাড়িভাবে’ নিচু হয়ে যায়। এটি ২৮ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে ৮ হাজার ফুট খাড়াভাবে নামে। যা হয়েছে, খুব দ্রুত হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানটি খুব দ্রুত গতিতে নিচে নেমে আসছে এবং এর নাকটি প্রায় সোজা বরাবর নিচের দিকে ছিল। এছাড়া বিমানের পেছনের দিকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখা যাচ্ছিল।

ওয়াগান গ্রুপের টেলিগ্রাম চ্যানেল গ্রে জোনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ওই বিমানটিকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। যদিও তারা তাদের দাবির বিষয়ে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি। প্রিগোশিনের মালিকানাধীন দ্বিতীয় আরেকটি বাণিজ্যিক জেট বিমান নিরাপদে মস্কোয় অবতরণ করে বলে গ্রে জোন জানিয়েছে। ব্রাজিলিয়ান বিমান উৎপাদনকারী এমব্রায়ার জানিয়েছে, যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তারা কোনো সার্ভিস করেনি। বিমানটিতে একসঙ্গে ১৩ জন ভ্রমণ করতে পারতেন। তবে বিধ্বস্ত বিমানটি প্রিগোশিনের একটি কোম্পানির নামে নিবন্ধিত ছিল।

বিমানটিতে যারা ছিলেন : বিধ্বস্ত বিমানটিতে ৭ যাত্রী ও ৩ ক্রু ছিলেন। রাশিয়ার বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ওই ৭ যাত্রীকে শনাক্ত করেছে। তারা হলেন- ইয়েভগেনি প্রিগোশিন, তার প্রধান সহচর দিমিত্রি ইউতকিন, সের্গেই প্রপুস্টিন, ইয়েভগেনি মাকারান, আলেকসান্দার ততমিন, ভ্যালেরি চেকালভ এবং নিকোলাই মাতুসিয়েভ। ক্রু সদস্যরা হলেন- ক্যাপ্টেন আলেক্সি লেভশিন, সহ-পাইলট রুস্তাম কারিমভ এবং ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট ক্রিস্তিনা রাসপোপোভা।

নীরব পুতিন : প্রিগোশিনের মৃত্যুর বিষয়ে একেবারেই নীরব রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। বিধ্বস্ত হওয়া ও সেখানে প্রিগোশিন থাকার খবর প্রকাশের কিছুক্ষণ পরেই পুতিন একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। কুরস্ক অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বার্ষিকী উপলক্ষে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালে তিনি ইউক্রেনে বিশেষ সেনা অভিযানে নিহত রুশ সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তবে ওই অনুষ্ঠানে ওয়াগনার বা প্রিগোশিনকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি পুতিন। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার নিয়েও কোনো কথা বলেননি তিনি। বড় ধরনের ঘটনার পরে ক্রেমলিনের এই নেতা ‘পরিস্থিতি দেখুন এবং অপেক্ষা করুন’ নীতিতে চলেন। তিনি খুব কমই প্রতিক্রিয়া দেখান।

এ ডেড ম্যান ওয়াকিং : প্রিগোশিনের বিদ্রোহ ২৩ বছর ধরে রাশিয়ার ক্ষমতায় থাকা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। এই অভ্যুত্থানই আবার পিগোশিনকে লক্ষ্য বানিয়ে দিল। কিছু বিশেষজ্ঞ আগেই অনুমান করেছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে যুদ্ধবাজ প্রিগোশিনের মৃত্যু হতে পারে। আসলে তিনি এখন ‘এ ডেড ম্যান ওয়াকিং’। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই বিমান দুর্ঘটনার সঙ্গে পুতিন জড়িত থাকতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আসলে কী ঘটেছিল, আমি তা জানি না। তবে আমি এই দুর্ঘটনায় মোটেই বিস্মিত নই।’

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর মস্কো স্টেশনের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা ড্যানিয়েল হফম্যান বলেছেন, ‘আমার কোনো সন্দেহ নেই যে এ কাজ পুতিনের নির্দেশেই হয়েছে।’ তার মতে, গত জুনে প্রিগোশিনের ব্যর্থ বিদ্রোহের পর প্রেসিডেন্ট পুতিন তাকে গ্রেপ্তার না করে মিথ্যা নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিলেন, যাতে প্রিগোশিন স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারেন। আর সেই সুযোগে তাকে হত্যা করা যায়। সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা আরো বলেন, এটি পুতিনের নিরাপত্তার প্রশ্ন। যাকে গত জুনে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছিল তাকে আর কতদূর পর্যন্ত গ্রহণ করা যায়।

ফুল ও মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা : প্রিগোশিন ও ওয়াগনার সেনাদের প্রতি সাধারণ রুশ মানুষের যে সমর্থন রয়েছে, সেটা ব্যর্থ অভুত্থানের সময় দেখা গেছে। ওই সময়ের ভিডিওতে দেখা যায়, ওয়াগনার গ্রুপ স্বল্প সময়ের জন্য যেসব শহর দখল করেছিল, সেখানকার বাসিন্দারা উল্লাস প্রকাশ করছেন। তারা ওয়াগনার সেনাদের সঙ্গে ছবি তুলছেন। বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রিগোশিনের গাড়ি থামিয়ে তার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন।

প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অনেকেই ফুল, মোমবাতি ও ওয়াগনারের প্রতীক নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে জড়ো হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, ওয়াগনারের সদর দপ্তর ‘ওয়াগনার পিএমসি’-এর বাইরে বিরাট ব্যানার নিয়ে জড়ো হয়েছে অসংখ্য মানুষ। ব্যানারে লেখা ‘আমরা একসঙ্গে আছি’।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App