×

আন্তর্জাতিক

ভারত ও ফ্রান্সের সম্পর্ক জোরালো ভূমিকা রাখবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৩, ১২:৪৩ এএম

ভারত ও ফ্রান্সের সম্পর্ক জোরালো ভূমিকা রাখবে

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ‘বাস্তিল দিবস’ কর্মসূচিতে গত বৃহস্পতিবার বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বার্ষিক এই অনুষ্ঠানে ভারতের অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেছেন, বিশ্বের ইতিহাসে এটি ঐতিহাসিক ঘটনা, দুই দেশের আস্থার সম্পর্ক ভবিষ্যতে জোরাল ভূমিকা রাখবে। এ সময় ভারতকে ‘কৌশলী অংশীদার’ ও বন্ধু হিসেবেও তিনি আখ্যায়িত করেন।

মোদির এই সফরে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত একাধিক চুক্তি সই হওয়ার কথা। ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য ২৬টি রাফাল-এম ফাইটার জেটের চুক্তি চূড়ান্ত করতে পারেন মোদি। এছাড়া ডিজেল ইঞ্জিনের ডুবোজাহাজও কিনতে পারে ভারত। ফ্রান্স থেকে ফেরার পথে একদিনের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে সফর সেরে দেশে ফিরবেন মোদি।

ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান পেলেন মোদি : দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে পৌঁছেন নরেন্দ্র মোদি। রাতে বিখ্যাত এলিস প্যালেসে মোদির জন্য বিশেষ নৈশভোজের ব্যবস্থা করেন ফ্রান্সের ফার্স্ট লেডি ব্রিজেট ম্যাক্রোঁ। সেখানে লাল কার্পেটে হেঁটে প্রাসাদে প্রবেশ করেন মোদি। বিশেষ নৈশভোজের অনুষ্ঠানে মোদির হাতে দেশটির সর্বোচ্চ সম্মান লিজিয়ঁ দ্য অনারের গ্র্যান্ড ক্রস তুলে দেন প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাক্রোঁ।

ফ্রান্সের সাধারণ নাগরিক ও সামরিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে এই লিজিয়ঁ দ্য অনারই সবচেয়ে বড় সম্মান। প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লিজিয়ঁ দ্য অনারের সম্মান পেলেন মোদি। এর আগে তিনি মোট ১৩টি দেশ থেকে সেখানকার সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার ফ্রান্সের বাস্তিল দিবসের অনুষ্ঠানে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে যোগ দেন নরেন্দ্র মোদি। বাস্তিল দিবসের প্যারেডে ভারতীয় তিন বাহিনীর মোট ২৬৯ জন সদস্য অংশ নেন। পাশাপাশি ভারতীয় বিমান বাহিনীর ৩টি রাফাল ফাইটার জেটও ফ্রান্সের যুদ্ধবিমানগুলোর সঙ্গে ফ্লাইপাস্টে শামিল হয়।

১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের শক্তিশালী বাস্তিল দুর্গ দখল করে নেয় ফরাসিরা। ওই ঘটনাটিকে ফরাসি বিপ্লব ও আধুনিক ফ্রান্সের একটি প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই থেকে ১৪ জুলাই ফ্রান্সের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

শিশুকে আদর আর সেলফিতে মন জয় : বৃহস্পতিবার প্যারিস বিমানবন্দরে নামার পর মোদিকে অভ্যর্থনা জানান ফরাসি প্রধানমন্ত্রী এলিজাবেথ বোর্ন। বিমানবন্দরে তাকে দেয়া হয় গার্ড অব অনার। ভারতীয় গণমাধ্যম এইসময়ের খবরে বলা হয়, বিমানবন্দরের সামনের রাস্তায় মোদিকে এক ঝলক দেখার জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গাড়ি থেকে নেমে তাদের সঙ্গে দেখা করেন মোদি। শিশুদের আদর করা থেকে শুরু করে অনেকের আবদার মেটাতে তোলেন সেলফিও।

আইফেল টাওয়ারে চালু হচ্ছে ইউপিআই : নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ডিজিটাল লেনদেন ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতে। বড় শপিং মল থেকে পাড়ার পানের দোকান- সর্বত্রই এখন কিউআর কোডের উপস্থিতি। ভারতের পথ ধরে সিঙ্গাপুরে প্রথম চালু হয় ইউপিআই (ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেজ) ব্যবস্থা। পরে ভুটান, নেপাল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমানের মতো দেশে ভারতীয় ডিজিটাল মাধ্যম এবং ‘রুপে’ কার্ডের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন শুরু হয়। এবার ইউপিআইয়ের স্রোতে গা ভাসাতে চলেছে ফ্রান্স। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে চালু হচ্ছে ফ্রান্সের প্রথম ইউপিআই। গতকাল শুক্রবার প্যারিসে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং অনাবাসী ভারতীয়দের সভায় একথা জানিয়ে মোদি বলেন, ফ্রান্সেও ইউপিআই চালু হলে সার্বিকভাবে নগদ এড়িয়ে লেনদেনের ক্ষেত্র সুগম হবে। এর ফলে সুবিধা পাবেন ভারতীয় পর্যটকেরা।

যে কারণে রাফাল যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত : নরেন্দ্র মোদির ফ্রান্স সফরে বেশ কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্বাক্ষরিত হওয়ার ধারণা পাওয়া গেছে। ভারতের বার্তাসংস্থা এএনআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রকে উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করেছে, ফ্রান্স থেকে আরো ২৬টি রাফাল জেট এবং ৩টি স্কর্পিওন ক্লাস সাবমেরিন কেনার প্রস্তাবে ভারতের ডিফেন্স অ্যাকুইজিশন কাউন্সিল এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছে। এই ২৬টি রাফাল জেটের মধ্যে ২২টি হবে একক আসনের রাফাল মেরিন এয়ারক্র্যাফট। বাকি ৪টি টুইন-সিটার ট্রেনার এয়ারক্র্যাফট।

এর আগে ২০১৬ সালে ফ্রান্সের ডাসোঁ এভিয়েশন থেকে মোট ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার চুক্তিতে সই করেছিল। সেই চুক্তিতে বিরাট অঙ্কের আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে কংগ্রেসসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো। কিন্তু পরে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট সেই অভিযোগ খারিজ করে দেয়। যদিও ফ্রান্সে এখনো সেই অভিযোগ নিয়ে সমান্তরাল তদন্ত চলছে।

ওই চুক্তি অনুযায়ী, ভারতের মোট যে ৩৬টি রাফাল জেট পাওয়ার কথা ছিল, কয়েক কিস্তিতে তার সবগুলোরই ডেলিভারি হয়ে গেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যখন ৩৬তম তথা শেষ রাফালটি ভারতে পৌঁছায়, তখন আমিরাতে সেটির রিফিউয়েলিংয়ের ছবি পোস্ট করে ভারতের বিমানবাহিনী টুইট করেছিল, ‘দ্য প্যাক ইজ কমপ্লিট!’ তবে শেষ ডেলিভারির মাত্র ৬-৭ মাসের মধ্যেই ভারত আবার ফ্রান্স থেকে নতুন করে ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমানের অর্ডার দিতে যাচ্ছে। এ সিদ্ধান্তকে সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।

বিবিসি বাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, এয়ার চিফ মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) অরূপ রাহা বলেন, প্রথম যখন রাফাল জেট কেনার কথাবার্তা শুরু হয়, তখন তো ১২৬টি পাওয়ার কথা ছিল। সেই জায়গায় চুক্তি হয়েছে মাত্র ৩৬টির, ফলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজন এখনো পুরোটা মেটেনি। তিনি বলেন, এখন এয়ারফোর্সকেও তাদের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি ফাইটার জেট দিতে হবে, সেটা রাফাল না-হলেও কোনো ফোর পয়েন্ট ফাইভ জেনারেশন অত্যাধুনিক এয়ারক্র্যাফট হতে হবে- যা দুনিয়ার সেরা। কিন্তু আপাতত এই যে নতুন ২৬টি রাফাল, এগুলো এয়ারফোর্স নয়- কাজে লাগানো হবে ভারতের নৌবাহিনীতে।

অর্থাৎ, এই রাফাল জেটগুলো নৌবাহিনীর এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ারের ডেক থেকে টেক-অফ বা ডেকে ল্যান্ডিং করতে পারবে। সামুদ্রিক পরিবেশে যুদ্ধ করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হবে এগুলোর বডি আর ইঞ্জিন। ভারতীয় নৌবাহিনীর বহরে রাফাল জেটের অন্তর্ভুক্তি- যেগুলো আইএনএস বিক্রান্ত বা আইএনএস বিক্রমাদিত্যের মতো এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার থেকে অপারেট করতে পারবে, সেটিকেও পরিপূর্ণ একটি ‘ত্রিমাত্রিক বাহিনী’তে পরিণত করবে।

ভারতের কাছে যুদ্ধবিমান বিক্রির জন্য পৃথিবীর বহু দেশই আগ্রহী। এক্ষেত্রে রাফালের সঙ্গে মূল প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছিল মার্কিন যুদ্ধবিমান এফ-১৮র, কিন্তু আপাতত রাফালই ভারতে বাজিমাত করতে চলেছে।

এয়ার চিফ মার্শাল অরূপ রাহা মনে করেন, এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফ্যাক্টর রাফালের পক্ষে গেছে। এর একটি হল, আগে থেকেই ভারতের কাছে ৩৬টি রাফাল জেট আছে বলে ভারতীয় বাহিনী এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত। অর্থাৎ রাফালে যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র বিমানবাহিনী ব্যবহার করছে, মোটামুটি সেগুলোরই রকমফের নৌবাহিনীও ব্যবহার করতে পারবে। রাফাল থাকলে নৌবাহিনীর অস্ত্র বাছাই বা ‘ওয়েপন সিলেকশন’ কমন পড়বে। যুদ্ধে অ্যান্টি-শিপিং রোল, অর্থাৎ প্রতিপক্ষের জাহাজকে আক্রমণের ক্ষমতা অনেক বাড়বে।

আর দ্বিতীয় কারণ- ফ্রান্স রাফালের ক্ষেত্রে বহুলাংশে ভারতে ‘টেকনোলজি ট্রান্সফার’ বা প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছে। ভারতের মাটিতেই তাদের অন্তত দুটি সার্ভিসিং ফেসিলিটি আছে। সেখানে রাফালের হ্যাঙ্গার, ফিক্সচারস, রিপেয়ারিংয়ের ব্যবস্থা ও ল্যাবরেটরি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভারতের মাটিতেই ফরাসি সংস্থা ডাসোঁ এভিয়েশন ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে সেটি গড়ে তুলেছে বলেই এই রাফাল জেটগুলোর ‘লাইফটাইম ম্যানেজমেন্ট’ অনেক সহজ হবে।

ভারতের সশস্ত্র বাহিনী প্রায় সত্তর বছর আগে রাশিয়ায় নির্মিত মিগ সিরিজের যুদ্ধবিমান কেনার মধ্যে দিয়ে তাদের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আশির দশকে ফ্রান্সে নির্মিত মিরাজ যুদ্ধবিমানের মধ্যে দিয়ে প্রতিরক্ষা খাতে ফরাসি সহযোগিতার পর্ব শুরু হয়- যা এখন দ্বিতীয় রাউন্ডের রাফাল জেট সমঝোতার মধ্যে দিয়ে আরো প্রসারিত হতে চলেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App