×

আন্তর্জাতিক

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে যৌনরোগ সিফিলিস, লক্ষণগুলো কী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩, ০৫:১৩ পিএম

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে যৌনরোগ সিফিলিস, লক্ষণগুলো কী

সিফিলিসের উপযুক্ত চিকিৎসা না করালে যৌনাঙ্গ এবং মুখের চারপাশে এধরনের ফোঁড়া দেখা দেয়।

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে যৌনরোগ সিফিলিস। সিফিলিস বিশ্বের প্রাচীনতম যৌনরোগের অন্যতম। একসময় মনে করা হয়েছিল এর বিস্তার কমে গিয়েছে। কিন্তু এখন এই রোগ উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র সিডিসি সতর্ক করছে, সিফিলিসের মহামারি কমে আসার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এবং সিডিসি কিছু ‘আতঙ্কজনক’ নতুন প্রবণতার দিকে ইঙ্গিত করছে, যার কারণে এই রোগের সংক্রমণ হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে “কনজেনিটাল সিফিলিস” অর্থাৎ জন্মগত সিফিলিস, যেখানে একজন মা গর্ভাবস্থায় তার সন্তানের দেহে এই রোগের সংক্রমণ ঘটান। সাধারণত তিনি নিজে এতে সংক্রমিত হন তার যৌন সঙ্গীর কাছ থেকে। এই রোগের সংক্রমণে মৃত সন্তান প্রসব, শিশু মৃত্যু এবং আজীবন স্বাস্থ্য সমস্যা ঘটতে পারে। এই ঘটনা অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে বিচলিত করে তুলেছে। চৌদ্দশ নব্বইয়ের দশকে প্রথমবারের মতো রেকর্ড করার পর থেকে সিফিলিস রোগকে অনেকগুলো নামে ডাকা হয়েছে যার বেশিরভাগই বেশ অপ্রীতিকর: "ফরাসি রোগ," "নিয়াপলিটান রোগ," "পোলিশ রোগ" ইত্যাদি। কিন্তু সিফিলিসের একটি নাম স্থায়ী রয়ে গেছে: "চরম নকলবাজ।" সিফিলিস অন্যান্য রোগের সংক্রমণকে নকল করতে ওস্তাদ, এবং এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি খুব সহজেই নজর এড়িয়ে যায়। সময়মত চিকিৎসা করা না হলে, সিফিলিসের পরিণতি গুরুতর হতে পারে। অ্যামস্টারডামের ৩৩-বছর বয়সী প্রজেক্ট অফিসার তুষার দু দু’বার সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে সময় তার যৌন সঙ্গীর কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রথম অসুখের খবর পাওয়ার দিনটির কথা তার খুব মনে আছে। সে সত্যিই বিরক্ত হয়েছিল, বলছেন তিনি। এই অসুখের জন্য সে আমাকেই দোষারোপ করেছে, যা ‘উইন্ডো পিরিয়ডে’র কারণে একেবারে অসম্ভব। দায়ভার আমার কাঁধে ফেলার বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে এবং তার রাগারাগি কমাতে কিছুটা সময় লেগেছে। ঐ সপ্তাহেই তুষার সিফিলিসের পরীক্ষা করান এবং চিকিৎসা শুরু করেন। লোকেরা ভুল করে মনে করে যে সিফিলিস এমন একটি রোগ যার কোন চিকিৎসা নেই। শরীরে সিফিলিস অ্যান্টিবডি থাকা এবং সংক্রমণ না থাকার মানে যে কি মানুষ এখনও তা বুঝতেই পারে না।" গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যৌন সংক্রামিত রোগ বা এসটিআই-এর সর্বশেষ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, সিফিলিসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি -২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিসের কেস ৩২ শতাংশ বেড়ে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে। লিয়েন্ড্রো মেনা, সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক বলেন, ১৫-২০ বছর আগে আমরা ভেবেছিলাম যে আমরা সিফিলিস নির্মূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কোন সন্দেহ নেই যে এখন আমরা সিফিলিসের বৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি, এমন এক হারে যেটি আমরা গত ২০ বছরে দেখিনি। সিফিলিসের সংক্রমণ যে কেবল যুক্তরাষ্ট্রে ঘটছে তা কিন্তু না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী সিফিলিসের ৭১ লক্ষ নতুন কেস ধরা পড়েছে। ২০২০ সালে ব্রিটেনে ১৯৪৮ সালের পর থেকে সিফিলিস কেস সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। সিফিলিস রোগ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা দানকারীরা একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করছেন। ব্রিটেনের এসটিআই ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার জোডি ক্রসম্যান বলেন, ২০০৫ সালে যখন আমি প্রথমবারের যৌন স্বাস্থ্য নিয়ে নার্সিং শুরু করি, তখন প্রাথমিক পর্যায়ের সিফিলিস কেস খুঁজে পাওয়া ছিল খুবই বিরল, এমনকি শহরের কেন্দ্রস্থলের ক্লিনিকেও এটা দেখা যেতো না। এখন ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সিফিলিস সংক্রমণের হার ৮.৪ শতাংশ বেড়েছে। এখন বেশিরভাগ শহর-ভিত্তিক ক্লিনিকগুলিতে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন রোগীকে সিফিলিস চিকিৎসার জন্য হাজির হতে দেখা যায়। যৌনরোগ সিফিলিস-এর লক্ষণগুলো কী সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটে ট্রেপোনেমা প্যালিডাম নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। এই রোগের লক্ষণগুলোতে রয়েছে চারটি ধাপ। প্রথম ধাপে নারী বা পুরুষের যৌনাঙ্গে এক ধরনের ব্যথাহীন কালশিটে বা ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এই পর্যায়ে পেনিসিলিন ইনজেকশনের একটি ইন্ট্রামাসকুলার ডোজ সংক্রমণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে চিকিৎসা না করা হলে সিফিলিসের কারণে দীর্ঘমেয়াদী স্নায়বিক এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ হতে পারে। সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিফিলিসের ঘটনা ঘটছে সমকামী, উভকামী এবং অন্যান্য পুরুষদের মধ্যে যারা পুরুষদের সাথে যৌনসংগম করেন। গর্ভাবস্থায় মায়ের দেহ থেকে অনাগত শিশুর দেহে সিফিলিসের সংক্রমণ ঘটলে তার পরিণতি হতে পারে বিপর্যয়কর: প্রসূতির গর্ভপাত হতে পারে, মৃত সন্তান প্রসব কিংবা অকাল প্রসব ঘটতে পারে, নবজাতকের জন্মের সময় ওজন কম হতে পারে এবং জন্মের পরপরই শিশুর মৃত্যুও ঘটতে পারে। মার্কিন সীমান্তের ওপারে ক্যানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সিফিলিস মহামারি ছড়িয়ে পড়তে দেখেছেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগের চিকিৎসক ও গবেষক আইজ্যাক বোগোচ। বিশ্বের একাধিক দেশেই এই প্রবণতাটি দেখা যাচ্ছে। এটি খুবই উদ্বেগজনক কারণ সিফিলিসের চিকিৎসা করা সাধারণত খুবই সহজ, এবং এর চিকিৎসাও সহজলভ্য। সুতরাং, এর অনেকটাই ঘটছে নানা দেশে জনস্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোতে বিপর্যয়ের কারণে। উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে মার্শফিল্ড ক্লিনিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটের সহযোগী গবেষণা বিজ্ঞানী মারিয়া সুন্দরম বলছেন, আমাদের জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা পরিকাঠামোতে যে অন্তর্নিহিত বৈষম্য এবং বর্ণবাদ রয়েছে এসব ঘটনায় সেটাই প্রতিফলিত হয়। নারীদের সবচেয়ে দুর্বল গোষ্ঠী, যারা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন কিংবা মাদক নেশার সাথে লড়ছেন, তারাই সিফিলিস রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আর বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি এই বৈষম্যগুলিকে অনেকগুলি বাড়িয়ে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা একমত যে সিফিলিস-সহ বিভিন্ন যৌন রোগ সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সাথে সম্ভবত কোভিড মহামারি চলার সময় এসটিআই প্রতিরোধ ব্যবস্থাগুলির কাজে ব্যাঘাতের একটা সম্পর্ক রয়েছে। সিফিলিস রোগের মহামারির পেছনে যেসব সমস্যা কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো: যৌনরোগ পরীক্ষা কেন্দ্রে সেবা নিতে গিয়ে সমস্যা, সিফিলিসকে ঘিরে লজ্জা এবং সামাজিক কলঙ্ক, এবং সম্ভবত ভাষাগত বাধা। ব্রাজিলের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, স্কুলে যাননি এমন কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মধ্যে জন্মগত সিফিলিসের হার অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই, সিফিলিস স্ক্রিনিং করে এমন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সমস্যায় পড়তে হয়। সিডিসি’র যৌন রোগ প্রতিরোধ বিভাগের পরিচালক লিয়েন্ড্রো মেনা বলেন, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে এইচআইভি/এইডস-এর অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল থেরাপি চালু হওয়ার পর বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল। এখন এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অগ্রগতির কারণে এইচআইভিকে একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ হিসাবেই দেখা হচ্ছে। এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসায় কনডম ব্যবহার কিংবা যৌনরোগের বিরুদ্ধে অন্যান্য প্রতিরোধ নিতে মানুষের মধ্যে আগ্রহ এখন অনেকখানিই কমে গেছে। জাপানের গবেষকরা ডেটিং অ্যাপ এবং সিফিলিসের সাথে সম্পর্ক থেকে মানুষের যৌন অভ্যাসের পরিবর্তন দিকটি বোঝার চেষ্টা করছেন। গবেষণা থেকে তারা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারের সাথে "সিফিলিস সংক্রমণের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য। এসব অ্যাপের ব্যবহারের ফলে অনিরাপদ যৌনমিলনের ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। বেশিরভাগ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলছেন, সিফিলিস রোগ মোকাবেলার পথটি সোজা: এর বিরুদ্ধে লড়াই করার ওষুধ আমাদের হাতে আছে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঘটনা বাড়লেও পেনিসিলিন এক্ষেত্রে এখনও সেরা চিকিৎসা। নিরাপদ যৌন চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য আরও বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন, সিফিলিসের সাথে সামাজিক কলঙ্ক দূর করতে আরও বেশি করে প্রচারের পাশাপাশি এই বিষয়টি নিয়ে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। ব্রিটেনের এসটিআই ফাউন্ডেশনের জোডি ক্রসম্যান বলেছেন, আমরা সামাজিক প্রাণী, তাই সর্দি-জ্বর পরীক্ষায় যতখানি লজ্জা রয়েছে তার চেয়ে বেশি লজ্জা এসটিআই রোগ নির্ণয়ে থাকা উচিত না। আমরা এসটিআই পরীক্ষার ফোকাসকে ভীতিকর কিছু থেকে এমন কিছুতে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি যা আমাদের যৌন সুস্থতার অংশ - যা নিরাপদ ও উপভোগ্য যৌন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত কোন একটি একক তত্ত্বে পৌঁছাতে পারেননি যে কেন অন্যান্য যৌনরোগের তুলনায় সিফিলিস বেশি দ্রুত হারে বাড়ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App