×

আন্তর্জাতিক

পরিবর্তনের নেতৃত্বে কে এই পিটা লিমজারাট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৩, ০৮:৪৪ এএম

পরিবর্তনের নেতৃত্বে কে এই পিটা লিমজারাট

পিটা লিমজারাট।

থাইল্যান্ডের নির্বাচনে অবিশ্বাস্য জয়ের নায়ক পিটা লিমজারাট। তার দল ‘মুভ ফরোয়ার্ড’ অন্য যে কোনো দলের তুলনায় আসন এবং ভোট- দুটোই বেশি পেয়েছে। আর এর মাধ্যমে গত এক দশক ধরে সেনাসমর্থিত সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে দেশটির জনগণ।

গত রবিবারের নির্বাচনের পরদিন সোমবার নিজেদের বিজয়ী দাবি করে গণতন্ত্রপন্থি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) বলেছে, থাইল্যান্ডে প্রায় এক দশক ধরে সেনাসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় রয়েছে। এবারের নির্বাচনে ভোটাররা সেনাসমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বেছে নিয়েছেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের।

রাজধানী ব্যাংককে এমএফপির সদর দপ্তরে পিটা লিমজারাট সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি পিটা লিমজারাট। আমি থাইল্যান্ডের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আমরা সরকার গড়তে প্রস্তুত রয়েছি।’ এ সময় ‘সবার প্রধানমন্ত্রী’ হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তরুণ এ নেতা।

প্রাথমিক ফলে দেখা যাচ্ছে, সব প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়ে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি থাই পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষের ৫০০ আসনের মধ্যে ১৫১টি আসনে জয়লাভ করেছে। ব্যাংককে ৩৩টি আসনের মধ্যে পেয়েছে ৩২টি আসন। দ্বিতীয় স্থানে থাকা দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাসিত নেতা থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার ফেউ থাই পেয়েছে ১৪১ আসন। অন্যদিকে নির্বাচনী ফলাফলে পঞ্চম হয়েছে ক্ষমতাসীন দল।

এখন জোট সরকার গড়তে নীতিগতভাবে একমত হয়েছে এমএফপি ও ফেউ থাই। তবে এবারের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য বিষয় একসময়ের অভ্যুত্থানের হোতা থাই প্রধানমন্ত্রী প্রাউত চান-ওচাকে ভোটারদের প্রত্যাখ্যান করা। প্রাউত চান-ওচাকে দেশটির অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও অধিকার রক্ষায় সরব ব্যক্তিদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর জন্য দায়ী করা হচ্ছে। যে দেশটিতে দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক শাসন চলেছে, সে দেশে এই বিজয়কে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

ব্যাংককে সংবাদ সম্মেলনে পিটা লিমজারাট বলেন, ‘এই সেন্টিমেন্ট পরিবর্তন হয়ে গেছে। এবং এটা হচ্ছে আসল সময়।’

কে এই পিটা লিমজারাট : পিটা লিমজারাটের জন্ম থাইল্যান্ডের এক ধনী পরিবারে। রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার পরিবারের। তার বাবা ছিলেন থাইল্যান্ডের কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং তার চাচা ছিলেন থাইল্যান্ডের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

পিটা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন নিউজিল্যান্ডে স্কুলে ছাত্র থাকাকালে। তিনি থাইল্যান্ডের থামাসাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক পলিসিতে মাস্টার্স করেন। এমবিএ করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। তবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন পিতার ব্যবসায় যোগ দিয়ে। পরে তিনি রাইড শেয়ারিং কোম্পানি গ্র্যাবের নির্বাহী পরিচালকও ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন থাই অভিনেত্রী এবং মডেল চুটিমা টিনপানাটকে, পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। এখন তিনি তার ৭ বছর বয়সি মেয়ে পিপিমকে নিয়ে একাই থাকেন।

থাইল্যান্ডে ২০২০ সালে প্রায় মাসখানেক ধরে ছাত্রদের নেতৃত্বে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিল ‘মুভ ফরোয়ার্ড’ পার্টি। এবার নির্বাচনে ‘মুভ ফরোয়ার্ড’ প্রার্থীদের অনেকেই ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতা। আর ২০২০ সালের সেই বিক্ষোভের মতো মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির বিজয়েও বড় ভূমিকা রেখেছে তরুণ, নিবেদিতপ্রাণ ভোটাররা।

পিটার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় ২০১৯ সালে ‘ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি’ থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে। এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থাইল্যান্ডের বিলিওনিয়ার ও সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক থানাথর্ন জুংরুংগ্রুয়াংকিট। থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে পরিবর্তনের ডাক দিয়ে ‘ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি’ ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে এবং দেশটির রাজনীতিতে নাড়া দেয়।

থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্রপন্থি সামরিক অফিসার, আমলা এবং বিচারকরা তখন রীতিমতো জোট বেঁধে সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে এই দলটিকে বিলুপ্ত করে, এর নেতাদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করে। এ রকম ঘটনা থাইল্যান্ডে আগেও বহুবার করা হয়েছে। দলটির নেতা থানাথর্নকে সংসদ সদস্য পদে অযোগ্য করা হয়।

এর পরপরই ‘মুভ ফরোয়ার্ড’ পার্টি গঠন করে নতুন নেতা নির্বাচন করা হয় পিটা লিমজারাটকে। ‘ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টি’কে নিষিদ্ধ করার পরে থাইল্যান্ডে হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে আসে বিক্ষোভ করতে। তাদের দাবি ছিল, সংবিধান সংস্কার, নতুন নির্বাচন এবং ভিন্ন মতাবলম্বী মানবাধিকার কর্মীদের হয়রানি বন্ধ করা।

পিটা লিমজারাটকে একসময় বলা হতো থাইল্যান্ড পার্লামেন্টের ‘উদীয়মান নেতা’ হিসেবে। বিরোধী এমপি হিসেবে পিটা লিমজারাট পার্লামেন্টে যেসব বক্তৃতা করেন, তা দ্রুতই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা খর্ব করা এবং রাজতন্ত্র সম্পর্কিত আইন সংস্কারের পক্ষে বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়ে কথা বলেন।

মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির উত্থান : নির্বাচনের আগে যখন প্রচারাভিযান চলছিল, তখন এই তরুণ দলটির পক্ষে এ রকম সমর্থনের আঁচ সহজেই পাওয়া যাচ্ছিল। থাই সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের পক্ষে নানারকম ‘মিম’ দিয়ে সয়লাব করে দেয়া হয়েছিল। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকেই তাদের বিরাট পদক্ষেপ নেয়ার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করছিল।

থাইল্যান্ড জুড়ে ভোটের বুথগুলোতে বাস্তবেও সেই একই ধরনের ভূমিকা নিতে দেখা গেছে ভোটারদের। ভোটের দিন ভোটাররা কেবল এভাবেই জানাতে পারছিলেন কোন দলের পক্ষে তারা ভোট দিচ্ছেন। কারণ থাইল্যান্ডের নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী, ভোটাররা প্রকাশ্য বলতে পারেন না, কাকে তারা ভোট দিচ্ছেন। অনেকে উজ্জ্বল কমলা রঙের শার্ট, স্যান্ডেল এবং জুতো পরেছেন- যেটি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নির্বাচনী প্রচারাভিযানের রং।

মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রার্থীদের অর্থকড়ি তাদের প্রতিদ্ব›দ্বীদের তুলনায় ছিল অনেক কম। তাদের নির্ভর করতে হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর। অনেক সময় তারা তাদের প্রচারাভিযানের জন্য ব্যবহার করেছে বাইসাইকেল। তাদের পরিকল্পনা যে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল, সেটি তাদের বেশ সাহায্য করেছে।

মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত ছিল এ রকম কোনো দলের সঙ্গে তারা জোট সরকার করবে না। থাইল্যান্ডে মানুষ পরিবর্তনের জন্য মুখিয়ে আছে, সেটি পুরোপুরি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির পক্ষে গেছে। থাইল্যান্ডে ২৬ বছরের কম বয়সি ভোটারের সংখ্যা বেশি নয়, ৫ কোটি ২০ লাখ ভোটারের মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু বয়স্ক ভোটারদের পক্ষে আনতে তারা কঠোর পরিশ্রম করেছে।

সরকার গঠনেও রয়েছে শঙ্কা : এমএফপির নেতা ও প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী পিটা লিমজারাট জানিয়েছেন, তিনি ৬টি দলকে সঙ্গে নিয়ে জোট গড়তে যাচ্ছেন। এ জোটে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার ফেউ থাই থাকছে। এই দুই দল এক জোটে এলে সরকার গঠনে বড় ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। পিটা আরো জানান, তিনি ফেউ থাইয়ের নেতা পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং সরকার গঠনের জন্য জোট গড়তে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

ভোটের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকা এই দুই দল সব মিলিয়ে নিম্নকক্ষের ৫০০ আসনের মধ্যে ২৯২টি পেতে পারে। অন্যদিকে সেনাসমর্থিত দুটি রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে ৭৬টি আসনে জয় পেতে পারে। কিন্তু এই ফলাফল চূড়ান্ত কথা নয়। কেননা, এর আগে সেনা অভ্যুত্থান কিংবা আদালতের রায়ে নির্বাচনের ফল ছুড়ে ফেলার ইতিহাস থাইল্যান্ডে রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App