×

আন্তর্জাতিক

সুদানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে: দুই জেনারেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫২ এএম

সুদানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে: দুই জেনারেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব

ছবি: সংগৃহীত

সুদানের রাজধানী খার্তুমসহ অন্যান্য শহরে চলছে সশস্ত্র লড়াই। এই লড়াইয়ে এক পক্ষে আছে দেশটির সেনাবাহিনী, অপর পক্ষে আছে সুদানের ক্ষমতাধর আধা সামরিক বাহিনী। দুই পক্ষের লড়াই মূলত ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে। এ লড়াইয়ের ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরুর ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে, লড়াই অব্যাহত থাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ চীনের কূটনীতিক ও নাগরিকদের সুদান থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। খার্তুমের বাসিন্দারা বলছেন, যে শহরে ঈদের সময়টায় উৎসবমুখর পরিবেশ থাকে তা যেন এখন এক ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থায় দুই পক্ষ ৭২ ঘণ্টার অস্ত্র বিরতিতে সম্মত হয়েছে।

মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া অস্ত্র বিরতি আগামীকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে পক্ষ দুটির মধ্যে বেশ কয়েকবার অস্থায়ী অস্ত্র বিরতির চুক্তি হলেও কোনো পক্ষই তা মানেনি। লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ৪২৭ জন নিহত হয়েছেন।

হঠাৎ কেন এই লড়াই : সুদানের সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) এবং ক্ষমতাধর আধাসামরিক বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনার পর ১৫ এপ্রিল লড়াই শুরু হয়। বিবদমান দুই পক্ষই একসময় মিত্র ছিল। দুই পক্ষ মিলে ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। কিন্তু আরএসএফকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে।

মূল প্রশ্নটি হলো, নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকছে এবং আরএসএফকে সামরিক বাহিনীতে একীভূত করার সময়ে কে সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হবেন। বিশ্লেষকদের মতে, এটা হলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতার দ্ব›দ্ব।

বেশির ভাগ লড়াই হচ্ছে রাজধানী খার্তুমে। তবে দেশজুড়ে সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার।

সুদানে চলমান এই সহিংসতার প্রধান চরিত্র সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তার সহকারী ও আরএসএফের প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, সবার কাছে যিনি জেনারেল হেমেদতি নামে পরিচিত। ২০২১ সালের অক্টোবরে আল-বুরহান ও দাগালো একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন, যা দীর্ঘদিনের শাসক ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে অপসারণের পর শুরু হওয়া বেসামরিক সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে ভঙ্গুর করে তোলে। আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতা থেকে সরাতে তারা দুজন একসঙ্গে কাজ করেছিলেন।

আল-বুরহানের জন্ম সুদানের উত্তরাঞ্চলে। ওমর আল-বশিরের প্রায় ৩০ বছরের শাসনামলে একজন সেনা কমান্ডার হিসেবে তার উত্থান। অভ্যুত্থানের পর তিনিই কার্যত সুদানের ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। এদিকে দাগালোর জন্ম দারফুর অঞ্চলে। উট চরানো আরব গোত্রের সদস্য তিনি। অভ্যুত্থানের পর আল-বুরহানের পরের অবস্থানে অভিষিক্ত হন তিনি।

অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট। এ সংকট সমাধানে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক নেতারা এক হয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনায় আরএসএফকে নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি নিয়েই বিপত্তি বাধে সবচেয়ে বেশি।

সুদানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন খায়ের খোলুদ নামের একজন বিশ্লেষক। তিনি বলেন, গত ডিসেম্বরে চুক্তির যে কাঠামো দাঁড়ায়, তা নিয়ে আল-বুরহান ও দাগালোর মধ্যে দ্ব›দ্ব শুরু হয়। ওই চুক্তিতে আল-বুরহানের সহকারীর বদলে দাগালোর অবস্থান তার সমান করার কথা বলা হয়।

খার্তুমভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক প্রতিষ্ঠান কনফ্লুয়েন্স অ্যাডভাইজরির প্রতিষ্ঠাতা খায়ের খোলুদ আরো বলেন, ক্ষমতার এই পরিবর্তনের কারণেই নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার এবং আরএসএফের একীভূত করা নিয়ে আলোচনা টেবিলে উত্তপ্ত বিতর্কের বদলে এই বিভেদ শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে।

আরএসএফ গঠন করা হয় ২০১৩ সালে। কথিত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপের সদস্যদের নিয়েই এই আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হয়। দারফুর অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত এই জানজাওয়িদ মিলিশিয়া গ্রুপ। ২০০০-এর দশকে দারফুর সংঘাতের সময় ওমর আল-বশির সরকার বিদ্রোহ দমনে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে। ২০১৭ সালে ওমর আল-বশির এই গোষ্ঠীকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে একটি আইন পাস করেন। এই আইনের ফলে আরএসএফ একটি স্বতন্ত্র বাহিনীর রূপ পায়।

মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের পররাষ্ট্রনীতি ও নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আদিল আব্দেল গাফার বলেন, ক্ষমতার দিক দিয়ে দ্রুত উত্থানের সঙ্গে ওমর আল-বশিরের মাধ্যমে দাগালোর ব্যবসায়িক অবস্থানও সংহত হতে থাকে। দাগালোর পরিবার স্বর্ণখনি, নির্মাণ খাত ও খামার ব্যবসা স¤প্রসারিত করে।

এই দাগালো পরে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২০১৯ সালে সুদানে বিক্ষোভ শুরু হলে বশিরকে উৎখাতের পর সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকারে তিনি উপপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

জটিল ভৌগোলিক অবস্থান : সুদানের সঙ্গে লোহিত সাগর, সাহেল অঞ্চল ও হর্ন অব আফ্রিকার সীমান্ত আছে। এর কৌশলগত অবস্থান ও কৃষিজ সম্পদের কারণে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নজর সুদানের দিকে। এর ফলে দেশটিতে সফলভাবে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া জটিল হয়েছে। সুদানের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং সংঘাতের প্রভাব পড়ে ইথিওপিয়া, শাদ, দক্ষিণ সুদানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর।

সীমান্তে বিতর্কিত কৃষিজমি, ইথিওপিয়ার টিগ্রে অঞ্চলের সংঘাত, যার কারণে হাজার হাজার শরণার্থী সুদানে আশ্রয় নিয়েছে এবং গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধের কারণে ইথিওপিয়ার সঙ্গে সুদানের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

ইয়েমেন যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে আরএসএফ যখন দেশটিতে তাদের সেনা পাঠিয়েছিল, তখন এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো পরাশক্তিগুলো। এখন উভয় পক্ষকে সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে তারা।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের হর্ন অব আফ্রিকাবিষয়ক পরিচালক অ্যালান বোসওয়েল বলেন, সুদানে বর্তমানে যে সংঘাত চলছে, তা বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই।

কনফ্লুয়েন্স অ্যাডভাইজরির খায়েরের মতে, দুই জেনারেলই এখন ক্ষুব্ধ। তারা রক্তের নেশায় মেতেছেন। এক পক্ষে বা উভয় পক্ষে ব্যাপক প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কেউই যে আর আলোচনার টেবিলে বসবেন না, তা বেশ অনুমান করা যায়।

দুই জেনারেলই একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। খায়ের বলেন, তারা কেউই এখন নিজেদের এই অবস্থান থেকে সরে আসবেন না। সশস্ত্র এই সংঘাত-লড়াই যত দীর্ঘ হবে, তত বেশি ভোগান্তি বাড়বে সাধারণ মানুষের। একই সঙ্গে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে কোনো জেনারেলই একক কর্তৃত্ব পাবেন না।

৭২ ঘণ্টার অস্ত্রবিরতি : সুদানের লড়াইরত পক্ষগুলো ৭২ ঘণ্টার অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়েছে। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এই অস্ত্রবিরতি বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

সুদানের সশস্ত্র বাহিনী (এসএএফ) জানিয়েছে, এ যুদ্ধবিরতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব মধ্যস্থতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন প্রথম এই অস্ত্র বিরতির কথা ঘোষণা করে জানান, দুদিন ধরে নিবিড় আলোচনার পর এ সমঝোতা হয়েছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এসএএফ ও আরএসএফকে এ সময়টিতে অবিলম্বে এবং পুরোপুরিভাবে অস্ত্র বিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে।

ব্লিংকেন জানান, যুক্তরাষ্ট্র আঞ্চলিক, আন্তর্জাতিক ও সুদানের বেসামরিক পক্ষগুলোকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করার বিষয়টি সমন্বয় করবে, যেটি স্থায়ী অস্ত্র বিরতির জন্য কাজ করবে ও মানবিক ব্যবস্থাপনাগুলো দেখভাল করবে। এদিকে জাতিসংঘ সুদান ছাড়বে না বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস।

সংস্থাটি সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করবে। গুতেরেস বলেন, জাতিসংঘ সুদান ত্যাগ করবে না। একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য সুদানের জনগণের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার। এই ভয়াবহ সময়ে আমরা তাদের পাশে আছি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App