×

আন্তর্জাতিক

চীনে ইউরোপীয় নেতাদের ঢল, দুশ্চিন্তায় ভারত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৬ এএম

চীনে ইউরোপীয় নেতাদের ঢল, দুশ্চিন্তায় ভারত

ছবি: সংগৃহীত

তাইওয়ান ঘিরে চীনের সামরিক মহড়া শুরু

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের সঙ্গে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের বৈঠক নিয়ে ক্ষুব্ধ চীন গতকাল শনিবার তাইওয়ানের আশপাশে ৩ দিনের সামরিক মহড়া শুরু করেছে। তবে এই মহড়ার বিপরীতে শান্ত প্রতিক্রিয়া দেখানোর আশ্বাস দিয়েছে স্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। লস এঞ্জেলেসে মার্কিন স্পিকার কেভিন ম্যাককার্থির সঙ্গে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় স্বশাসিত দ্বীপটির কাছে চীন মহড়া করবে বলে আগে থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল, সাই ইং-ওয়েন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পরদিন চীনের ঘোষণায় সেই অনুমান সত্য হল। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককলের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের তাইওয়ান সফরের মধ্যেই এই মহড়া শুরু হলো।

চীন তাইওয়ানকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে দেখে। দ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ থেকেও পিছপা হবে না বলে হুঁশিয়ার করেছে বেইজিং। ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দুই নেতার চীন সফর শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর বেইজিং তাইওয়ানের আশপাশে সামরিক মহড়া শুরুর ঘোষণা দেয়। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইউনাইটেড শার্প সোর্ড’ বা ‘ঐক্যবদ্ধ ধারালো ছুরি’ নামে শুরু হওয়া মহড়াটি আগামী সোমবার পর্যন্ত চলবে।

সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড বলেছে, তাইওয়ানের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ও বাইরের শক্তির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া এবং উসকানির বিরুদ্ধে এটা গুরুতর হুঁশিয়ারি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার সুরক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ। স্থানীয় নৌ কর্তৃপক্ষ বলেছে, সোমবার মহড়ার শেষ দিনে চীনের ফুজিয়ান প্রদেশের উপকূলে তাজা গুলির অনুশীলন চালানো হবে। এ প্রদেশটির অবস্থান তাইওয়ানমুখী।

এদিকে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ও ব্যাপক মাত্রায় সতর্ক রয়েছে। দ্বীপের নিরাপত্তা রক্ষায় যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখানো হবে বলেও সতর্ক করেছে তারা। আরো বলেছে, চীন সাই ইং-ওয়েনের যুক্তরাষ্ট্র সফরকে তাদের সামরিক মহড়ার জন্য ‘অজুহাত হিসেবে’ কাজে লাগাচ্ছে, এসব সামরিক মহড়া অঞ্চলের ‘শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার’ গুরুতর ক্ষতি করে আসছে। তাইওয়ানের সামরিক বাহিনী ধীরস্থির, যৌক্তিক ও গুরুতর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় ‘না উত্তেজনা বৃদ্ধি, না বিরোধ’ এই নীতি অনুসারে পাহারা ও পর্যবেক্ষণে থাকবে।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, শনিবার দ্বীপ এলাকাটির কাছে ৮টি চীনা যুদ্ধজাহাজ ও ৪২টি যুদ্ধবিমান শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের মধ্যরেখা অতিক্রম করেছে। চীনের এ ধরনের আচরণকে অযৌক্তিক তৎপরতা উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর নিন্দা জানিয়েছে।

কূটনীতি ও মহড়া : চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র পিপলস ডেইলির শনিবারের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তাইওয়ানের বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে কোনো ধরনের চেষ্টাকে আটকে দেয়ার শক্তিশালী সক্ষমতা রয়েছে চীন সরকারের। এতে বলা হয়, ‘চীন সরকারের নেয়া সমস্ত পাল্টা ব্যবস্থা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের বৈধ ও আইনি অধিকারের অন্তর্গত।’

এদিকে সাই বলছেন, তাইওয়ানের জনগণই কেবল তাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তিনি একাধিকবার চীনের সঙ্গে বসার প্রস্তাবও দিয়েছেন, কিন্তু তাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ মনে করা বেইজিং প্রতিবারই সেসব প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাককার্থির সঙ্গে সাইয়ের বৈঠক হলে ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ নেয়ার হুমকি আগেই দিয়ে রেখেছিল বেইজিং। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টের পরই প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের অবস্থান। গত বছর আগস্টে সে সময়কার মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পাল্টায় চীন তাইওয়ানের আশপাশে তাজা ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়াসহ ব্যাপক সামরিক মহড়া চালিয়েছিল।

চীনে ইউরোপীয় নেতাদের ঢল, দুশ্চিন্তায় ভারত : মাত্র ৬ মাস আগেই নয়াদিল্লি এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করেন ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁর বিশেষ আস্থাভাজন ক্যাথরিন কোলোনা। বৈঠকের পরে ক্যাথরিন বলেছিলেন, চীনের আক্রমণাত্মক মনোভাব সম্পর্কে ভারত এবং ফ্রান্সের এক আশ্চর্য মিল রয়েছে।

তবে ভারত কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গেই লক্ষ্য করছে, ফ্রান্সের চীন-নীতিতে তারতম্য ঘটেছে। শুধু ফ্রান্সই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই গত একমাসে চীন অভিমুখী। যেন সফরের ঢল নেমেছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লিয়েন এই মুহূর্তে বেজিংয়ে। সম্প্রতি তিনি ব্রাসেলসে একটি বক্তৃতায় ইউরোপের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য পরিকল্পনা তৈরি করে দিতে চেয়ে বলেছেন, চীনের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ইউরোপের জন্য ক্ষতিকর। বরং চীনের সঙ্গে সম্পর্কে যা যা ঝুঁকি বা বিপদের দিক রয়েছে, সেগুলো কমিয়ে আনতে হবে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ গত বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ে বৈঠক করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে। ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে থামানো যায়, সে নিয়ে কথা বলেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ নভেম্বরে চীন সফর করেন। ডিসেম্বরে যা ইউরোপীয় কাউন্সিলের নেতা শার্ল মিশেল। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজও গত সপ্তাহে বেইজিং সফর করেছেন।

কূটনৈতিক মহল বলছে, ইউরোপের নেতাদের চীনে এত বার সফরের একাধিক উদ্দেশ্য রয়েছে। প্রথমত, রাশিয়াকে ক্রমাগত সামরিক সাহায্য জোগানো থেকে বেইজিংকে বিরত রাখা। ইউরোপের ধারণা, চীন যদি তার যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে পুরোপুরিভাবে রাশিয়ার পাশে দাঁড়ায়, খুব বড় মাপের সংঘাত ও সংকট এড়ানো যাবে না। দ্বিতীয়ত, যেভাবে মস্কো বেইজিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ছে, তা ইউরোপের কৌশলগত স্বার্থের জন্যও সহায়ক নয়। বরং চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে রাশিয়ার সঙ্গে প্রয়োজনীয় দর কষাকষি করতে পারবে ইউরোপ। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক এবং বাণিজ্য যুদ্ধের শরিক যে ইউরোপ হতে চায় না, সেই বার্তাও জিনপিংকে দিতে চাইছে ইউরোপীয় কমিশন। এটা ভুললে চলবে না যে, ইইউ এবং চীনের মধ্যে রয়েছে ৯০ হাজার কোটি ডলার বাণিজ্য ও পরিষেবা চুক্তি।

ভারতের কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, কোয়াড বা মার্কিন নেতৃত্বাধীন চতুর্মুখী অক্ষের সদস্য না হলেও ফ্রান্সের স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগারীয় অঞ্চলকে ঘিরে। এখানে ফরাসি দ্বীপগুলো রয়েছে, যা নৌ বাণিজ্য পরিবহনের অন্যতম স্পর্শকাতর এলাকাও বটে। ভারত এ-ও খেয়াল করেছে যে, মাক্রোঁর সঙ্গে চীন সফর করেছেন বেশ কিছু সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার কর্তারা। তাদের সঙ্গে চীনের চুক্তি ভারতের জন্য অনুকূল না-ও হতে পারে। চীন ভারতের অন্যতম বড় বাণিজ্য অংশীদার এবং সেইসঙ্গে কৌশলগতক্ষেত্রে খুব বড় চ্যালেঞ্জও বটে। ফলে ফ্রান্স তথা ইউরোপের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলে তা ভারত এবং ইউরোপের সম্পর্কে বদল আনতে পারে। সূত্র : রয়টার্স ও আনন্দবাজার

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App