×

আন্তর্জাতিক

আরবি ভাষায় ভুয়া খবর প্রচার করছে রাশিয়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৮ এএম

আরবি ভাষায় ভুয়া খবর প্রচার করছে রাশিয়া

ছবি: সংগৃহীত

বিবিসির ডিসইনফরমেশন টিম জানতে পেরেছে যে ব্রিটেনে নিবন্ধিত এক মিডিয়া কোম্পানি বিশ্বের লক্ষ লক্ষ আরবি-ভাষী মানুষের কাছে রাশিয়ার সরকারের হয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। ইয়ালা নিউজ নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদানের দাবি করে, কিন্তু বিবিসির বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, এর প্রকাশিত বেশিরভাগ কন্টেন্ট সরাসরিভাবে রুশ রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সাইটগুলো খবর প্রচার করে এবং এটি আসলে সিরিয়া থেকে কাজ করে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ইয়ালা নিউজের মূল কোম্পানি ইয়ালা গ্রুপের উপস্থিতি বেশ শক্তিশালী। এর ২০ বা ততোধিক ফেসবুক পাতা দেখতে বেশ ঝকঝকে এবং ভালভাবে তৈরি। এর চটকদার ভিডিওগুলি প্রতি কয়েক ঘণ্টা পর পর আপলোড করা হয়, এর ত্রিশ লক্ষ আরবি-ভাষী ফলোয়ারকে আকৃষ্ট করতে পারে এমন সব কন্টেন্ট প্রচার করা হয়: সেলিব্রিটিদের সাক্ষাৎকার, কমেডি স্কেচ এবং বিশ্ব রাজনীতির নানা বিষয়। খবর বিবিসির।

ইয়ালা নিউজ সম্পর্কে যেসব রিভিউ রয়েছে সেগুলোতে দাবি করা হয়েছে যে তারা নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন। কিন্তু একটু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে এর খবরগুলোয় থাকে রাশিয়ানপন্থী অবস্থানের প্রতিফলন, যে খবরগুলোর অনেকগুলি একই দিনে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কিছুদিন পরেই ইয়ালা নিউজের পোস্টগুলি দর্শক-পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করে।

এখানে একটি উদাহরণ তুলে দেয়া হলো: ২০২২ সালের ১০ই মার্চ রুশ রাষ্ট্রীয় টিভি উদ্ভট এবং সম্পূর্ণ কাল্পনিক একটি খবর প্রচার করে দাবি করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাখিকে জৈব অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে। এসব পাখি রাশিয়ায় উড়ে গিয়ে মারাত্মক সব রোগের জীবাণু ছাড়িয়ে দিচ্ছে। একই দিন বিকেলে ঐ খবরটি রুশ সরকারের-সমর্থিত নেটওয়ার্ক স্পুটনিক আরবি এবং রাশিয়া টুডে (আরটি) আরবিতে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়।

এর দু’ঘণ্টা পর ঐ খবরটি, কিছু কিছু শব্দ অপরিবর্তিত রেখে, ইয়ালা নিউজের ফেসবুক পাতায় ভিডিও হিসাবে পোস্ট করা হয়। জৈব অস্ত্র হিসেবে পাখির ব্যবহারের খবরটি শুধু একটি মাত্র ঘটনা।

এক বছর ধরে বিভ্রান্তিকর খবরের ওপর বিশেষজ্ঞদের সাথে নিয়ে বিবিসি ইয়ালা নিউজের সবচেয়ে বেশিবার দেখা হয়েছে এমন ভিডিওগুলি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছে, এবং দেখতে পেয়েছে যে এর প্রায় সব খবরের সূত্র হয় ক্রেমলিনের সরাসরি মালিকানাধীন, নয়তো বিভিন্ন ক্রেমলিন-পন্থী নিউজ সাইট।

এসব ভুয়া খবরে দাবি করা হয়েছে যে ইউক্রেনের বুচায় রুশ গণহত্যাটি ছিল সাজানো নাটক, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনে জনগণের প্রতি ভিডিওতে এক ভাষণ দেয়ার সময় বেহেড 'মাতাল' ছিলেন, এবং ইউক্রেনীয় সৈন্যরা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। এই সব খবর তৈরি হয়েছে রুশ রাষ্ট্রীয় মিডিয়াতে, এবং কয়েক ঘণ্টা পরই ইয়ালা নিউজে সেই খবরগুলির ভিডিও প্রচারিত হয়েছে।

'তথ্য লন্ডারিং'

বেলেন কারাসকো রড্রিগেজ ব্রিটেনের সেন্টার ফর ইনফরমেশন রেজিলিয়েন্স নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক প্রভাব নিয়ে কাজ করেন। তিনি বলছেন, ইয়ালা নিউজ মধ্যপ্রাচ্যে "ক্রেমলিনের লাউডস্পিকার" হিসেবে কাজ করছে৷

তিনি বলেন, খবর প্রচারের সময় এবং খবরের সাদৃশ্যগুলি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ইয়ালা নিউজ রাশিয়ার জন্য "তথ্য লন্ডারিং" করছে: তৃতীয় কোন পক্ষের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যাতে মনে না হয় ঐ খবরের সূত্রপাত হয়েছে ক্রেমলিন থেকে। এটি এমন একটি কৌশল যা রাশিয়া আগেও ব্যবহার করেছে।

"আরবি শ্রোতাদের মধ্যে ইয়ালা নিউজের জনপ্রিয়তার কারণে ক্রেমলিনের সাথে সম্পর্কিত সূত্রগুলি মনে করছে তাদের স্বার্থের পক্ষে করা করার জন্য নিউজ চ্যানেলটিকে ব্যবহার করা যেতে পারে," তিনি বলছিলেন।

সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম প্রোটেকশন গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের রুয়ারিগ থর্নটন বলছিলেন, মানুষ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সমর্থক মিডিয়া সম্পর্কে আরও বেশি সচেতন হওয়ার সাথে সাথে তথ্য ধোলাইয়ের ঘটনা ধীরে ধীরে সাধারণ ব্যাপার হয়ে উঠছে।

“কৌশলটি হলো: ভুয়া বর্ণনা রয়েছে এমন খবরকে “ধুয়ে মুছে” তাকে মূলধারায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। ডিজিটাল বিপণন সংস্থার মতো কিছু প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ করে এধরনের কন্টেন্ট তৈরি করা হয়। এসব কন্টেন্টে যেসব তথ্য থাকবে তার সাথে রাশিয়ার কোন ধরনের সংযোগ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরপর ঐ খবর বাস্তব দুনিয়ায় এমনভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে সেটি এমনিতেই লতায়-পাতায় বাড়তে থাকে," বলছিলেন তিনি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া রিভিউ

ইয়ালা নিউজ হলো ইয়ালা গ্রুপের অংশ যেটি নিজেকে বর্ণনা করে "সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ভিজ্যুয়াল প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে কাজ করে” এমন একটি কোম্পানি হিসেবে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বাকি অপারেশনটি এর সোশ্যাল সাইটের মতো অতটা চটকদার না। ইয়ালা গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেয়া রয়েছে কিছু ডামি টেক্সট এবং স্টক ফটো। ফেসবুকে এর বেশিরভাগ ফাইভ স্টার রিভিউ দৃশ্যত ভুয়া।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে একই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে একই তারিখে এসব রিভিউ লেখা হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে ফেসবুক রিভিউ লেখা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি বড় ব্যবসা হিসেবে সুপরিচিত। এরকম দুটি সাধারণ রিভিউগুলোতে ইয়ালা নিউজকে "নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ এবং পেশাদার" এবং "একটি চমৎকার, সৎ, এবং স্বচ্ছ সংবাদ প্ল্যাটফর্ম" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এসব প্রশংসার সাথে একমত নন ইন্সটিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের কর্মকর্তা মোস্তফা আয়াদ।

তিনি মনে করেন, ইয়ালা নিউজ প্রতিদিন অনেকগুলি ভিডিও পোস্ট করে যা একই ফরম্যাট অনুসরণ করে থাকে এবং হাজার হাজার ডলার খরচ করে এসব তৈরি করা হয়। ইয়ালা গ্রুপ ব্রিটেনে নিবন্ধিত একটি কোম্পানি। এর ঠিকানা মধ্য লন্ডনের ব্লুমসবারিতে। এই ঠিকানায় ৬৫ হাজারেরও বেশি অফিস রয়েছে, যার মধ্যে ১২,০০০ কোম্পানি এখন সক্রিয়। কিন্তু সেখানে এই ইয়ালা গ্রুপের নেই কোন অফিস কক্ষ কিংবা কোন কর্মচারী।

আমাদের সন্দেহ, ইয়ালা সিরিয়ার ভেতর থেকে কাজ করে। সিরিয়া গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ, যার শাসক বাশার আল-আসাদ রাশিয়ার দীর্ঘদিনের মিত্র। রাশিয়া ১২-বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধে আসাদ-পন্থী বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে।

স্থানীয়ভাবে পাওয়া তথ্য এবং জিওলোকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা ইয়ালার ফেসবুক পাতায় পোস্ট করা ছবিগুলোর সূত্র খুঁজে বের করেছি। এতে দেখা যাচ্ছে, এই সংস্থার কর্মী এবং এর অফিসটি দামেস্কের গাছপালায় ঢাকা এক শহরতলিতে অবস্থিত। কর্মচারীদের বেশিরভাগের সামাজিক প্রোফাইল থেকে জানা যাচ্ছে, তাদের অবস্থান সিরিয়ার রাজধানীতে। ইয়ালা গ্রুপের একজন সাবেক কর্মচারী বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছেন।

ইয়ালার ক্লায়েন্টদের মধ্যে রয়েছেন সিরিয়ার শাসক-পন্থী সেলেব্রিটি এবং সাংবাদিকরা। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টিভির একজন রিপোর্টার শাদি হালউই, যিনি ইয়ালা গ্রুপের একজন ক্লায়েন্ট, তিনি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় পড়া সিরিয়ান ব্যবসায়ী কাটেরজি ভাইদের সাথে পোজ দিচ্ছেন। মি. হালউই একটি রেডিও স্টেশনের মালিক যেটির অর্থ দিয়েছেন এই ক্যাটেরজি ভাইয়েরা।

ইয়ালার আরেকটি ক্লায়েন্ট হলো শাম এফএম। এটি একটি সরকার-পন্থী রেডিও স্টেশন যাতে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় রেডিও নেটওয়ার্কের অংশ স্পুটনিক আরবির তৈরি অনুষ্ঠানগুলি সম্প্রচার করা হয়।

বিবিসি মনিটরিং-এর সিরিয়ার মিডিয়া সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সমর্থক বেসরকারি মিডিয়া আউটলেটগুলি "প্রায়শই রাজনৈতিক এবং সামরিক বাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত ব্যবসায়ী ব্যক্তিদের মালিকানাধীন হয়।" বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্রিটেনে নিবন্ধিত হওয়ার সুবাদে ইয়ালা গ্রুপ দেখাতে পারে যে তারা নিষেধাজ্ঞার অধীন কোন দেশ থেকে কাজ করছে না।

ফলে তারা ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলির সাথে সহজেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। ইয়ালা গ্রুপের ফেসবুক পাতায় সম্প্রতি পোস্ট করে জানানো হয়েছে যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মেটার 'বিজনেস পার্টনার' হয়েছে, যার অর্থ এর সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং কোম্পানিগুলি ফেসবুকে মেটার সুপারিশ পেয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা মেটার সাথে যোগাযোগ করলে তারা সেটি অস্বীকার করেছে।

তাহলে ইয়ালা নিউজের পেছনে কে?

আমরা ইয়ালার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ মোয়েমনাকে খুঁজে বের করেছি। তিনি দুবাইতে বসবাসকারী একজন সিরিয়ান ব্যবসায়ী। "ইয়ালা গ্রুপ একটি ব্রিটেন-ভিত্তিক কোম্পানি," তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন। “নানা ধরনের জননেতা, শিল্পী এবং গুণী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ আমাদের ৫০০টিরও বেশি ক্লায়েন্ট রয়েছে। আমাদের এখনও লন্ডনে কোন কর্মচারী নেই, তবে অদূর ভবিষ্যতে আমরা ওখানেও কর্মচারী নিয়োগ করবো।”

ইয়ালা নিউজে ক্রেমলিন-পন্থী ভিডিওগুলি সম্পর্কে আমরা তাকে প্রশ্ন করেছি। জবাবে তিনি বলেছেন: “ইয়ালা নিউজের বিষয়বস্তু পক্ষপাতদুষ্ট নয়। সিরিয়া হোক কিংবা রাশিয়া বা অন্য কোন দেশ হোক, আমরা নিরপেক্ষতাকে সম্মান করি। এরপর আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করি, রুশ বা সিরিয়ার সরকারের কাছ থেকে তিনি কোন তহবিল পেয়েছেন কিনা। "আমিই ইয়ালার একমাত্র প্রতিষ্ঠাতা এবং কেউ আমাকে প্রভাবিত করতে পারে না," তিনি বলেন।

ব্রিটেনে ইয়ালার রেজিস্ট্রেশন সম্পর্কে আমরা কোম্পানিস হাউসকেও প্রশ্ন করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা "ব্যক্তিগত সংস্থাগুলির বিষয়ে কোন মন্তব্য করেন না" এবং "কোম্পানির প্রদান করা তথ্য যাচাই বা অনুমোদন করার কোনও আইনি ক্ষমতা” তাদের নেই। ফেসবুকের মালিক সংস্থা মেটা-র একজন মুখপাত্র বলেছেন, তাদের প্ল্যাটফর্মে ভুয়া তথ্যের বিস্তারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তারা তৃতীয় পক্ষের ফ্যাক্ট-চেকারদের সাথে কাজ করে।

ইয়ালা নিউজের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে কিনা তা জানার জন্য আমরা রাশিয়া এবং সিরিয়ার সরকারের সাথেও যোগাযোগ করেছি। কিন্তু আমাদের অভিযোগের ব্যাপারে কোন জবাব তাদের কাছ থেকে আসেনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App