×

আন্তর্জাতিক

ত্রিপুরায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে সিপিএম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৯ এএম

ত্রিপুরায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে সিপিএম

ফাইল ছবি

২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ত্রিপুরাতে সিপিএম দুর্বল

ত্রিপুরার জনজাতিদের রাজা বুবাগ্রার গ্রাসে বিলীন হচ্ছে ত্রিপুরার সিপিএম তথা বামপন্থিরা। টানা ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকা একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতা হারানোর মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে কতটা শেকড়হীন হয়ে যেতে পারে তা দেখাল ত্রিপুরার ভোটের ফল। সব মিলিয়ে সিপিএমের ভোট কমে রাজার দলে বাড়ছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে- বিধানসভায় বিরোধী দলের অবস্থান ধরে রাখার মতো শক্তিও নেই ত্রিপুরার বামপন্থিদের। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা থেকেও ছিটকে গেছে তারা। প্রসঙ্গত, ৫ বছর আগে ত্রিপুরা সিপিএম ১৬টি আসন পেলেও এবার পেয়েছে মোটে ১১টি। কংগ্রেসের হাত ধরে দলটি চেয়েছিল বৈতরণী পার হতে, কিন্তু তাতে ফল হয়েছে উল্টো।

তাহলে কি ত্রিপুরা থেকেও সিপিএম তথা বামপন্থিরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে আগরতলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশ্লেষক জয়ন্ত ভট্টাচার্য্য বলছিলেন, এবারের ভোটে বিজেপির স্লোগান ছিল ‘শান্তি এবং উন্নয়ন’। অপরদিকে সিপিএম-কংগ্রেসের (ত্রিপুরায় বলা হয় বামগ্রেস) স্লোগান ছিল ‘গণতন্ত্র ফেরানো’। কিন্তু ভোটের ফলাফলে দেখা গেছে, মানুষ শান্তি ও উন্নয়নের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।

এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবার বিজেপির যে স্লোগান- সেটি ছিল শান্তি এবং উন্নয়নের পক্ষে। তারা বলছে, ত্রিপুরা রাজ্যে তারা অনেক কাজ করলেও অনেক কাজ এখনো বাকি আছে। রেলের কাজ বাকি আছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় অনেকেই ঘর পেয়েছিল। অনেক বাথরুম হয়েছে। তারা বলছে উন্নয়নের পক্ষেই ভোট। অন্যদিকে, বামফ্রন্ট বলছে, ত্রিপুরা রাজ্যে গণতন্ত্র নেই। রাজনৈতিক দলের অফিস পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে এখানে সহ্য করা হচ্ছে না। এছাড়া বিজেপি একটি বাইক বাহিনী তৈরি করেছিল। এই বাইক বাহিনী নানা উছিলায় কংগ্রেস এবং সিপিএমের ওপর আক্রমণ করছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের রুটিরুজি নেই এবং তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারও হরণ করা হয়েছে। তাহলে দুটো ইস্যু। একটি হচ্ছে শান্তি ও উন্নয়ন, আরেকটি হচ্ছে গণতন্ত্র ফেরানো।

ভোট শেষ হওয়ার পর এই দুটোর মধ্যে দেখা গেছে, কংগ্রেস এবং সিপিএম আসন সমঝোতা করেছিল। মানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণে কংগ্রেসের যেসব ভোটার আছেন, তারা বামফ্রন্টকে দেননি। কেন দেননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৩৫ বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট, তবে মাঝখানে একবার ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। এর আগে ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। তো দেখা গেছে, তারা ছিল পরস্পর বিপরীতধর্মী পার্টি। তাদের মধ্যে মারামারি, হামলা-মামলা প্রায়ই হয়েছে। সাংঘাতিক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে। গণহত্যার মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এবারের ভোটে এসে সিপিএম এবং কংগ্রেস আসন সমঝোতা করে নিল। কিন্তু আগে থেকে চলে আসা শত্রুতার কারণে কংগ্রেসিরা সিপিএমকে ভোট দেয়নি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, ‘তিপ্রা মথা’ নামে নতুন একটি পাহাড়ি পার্টির জন্ম হয়েছে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন ত্রিপুরা রাজপরিবারের বংশধর প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেববর্মণ। কুড়িটি রিজার্ভ সিটের বাইরেও যেখানে কিছু পাহাড়ি ভোটার রয়েছে সেখানে তারা প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। দেখা গেছে, এসব আসনের পাহাড়িদের মধ্যে বেশির ভাগই

বামপন্থিদের সমর্থক। কিন্তু উগ্র যে দাবি, গ্রেটার তিপরাল্যান্ডের ডিমান্ড, এর ফলে জনজাতিদের অনেকেই আকৃষ্ট হয়ে তারা তিপ্রা মথাকেই ভোট দিয়েছেন। বামফ্রন্টকে ভোট দেননি। রিজার্ভ সিটের বাইরে তিপ্রা মথার একজন প্রার্থী না জিতলেও সিপিএমের ভোট কেটে নিয়েছে।

বিশ্লেষণে এও পাওয়া গেছে, একসময়ের ঘোরশত্রæ কংগ্রেসের সঙ্গে শত্রুতা মিটিয়ে হাতে হাত ধরে লড়াই করতে গিয়ে সিপিএমের সবকিছু আরো গেছে। ৫ বছর আগে ১৬টি আসনে জয়ী হলেও এবার ১১টিতেই এসে থামতে হয়েছে। ৫ বছর আগে ক্ষমতা হারিয়ে সিপিএম নেতারা যখন পাহাড়ি জনতার দিকে ঝুঁকলেন তখনো তারা বোঝেননি, এরা কারো জায়গির নয়। এমন পরিস্থিতিতে হাজির হন ত্রিপুরার জনজাতিদের বুবাগ্রা (রাজা) ত্রিপুরা রাজপরিবারের বংশধর প্রদ্যোৎ বিক্রম মাণিক্য দেববর্মণ। সঙ্গে পুইল্যা জাতির উলু পার্টির স্লোগান। কিছুদিন পরই তা বদলে গেল গ্রেটার তিপরাল্যান্ড আন্দোলনে। যে পাহাড়কে হাতের মুঠোয় রেখে সিপিএম একসময় ভোটের রাজনীতিতে ২০ এর পর ২১ থেকে গণনার হুঙ্কার দিতেন সেই পাহাড়ি জনতাই আশ্রয় নিলেন বুবাগ্রার তিপ্রা মথায়।

এরপরও সিপিএমের নেতারা বলেছিলেন, কমিউনিস্ট জনতা আর যাই হোক কাস্তে-হাতুড়ি প্রতীক ফেলে অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দেবে না। কিন্তু এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে মথায় আশ্রিত জনজাতিরা আনারসেই ডুব দিলেন। এমনকি যেসব আসনে তিপ্রা মথার জয়ের সম্ভাবনা নেই সেখানেও ঢালাও হারে ভোট দিলেন। যে কারণে শুধু উপজাতি সংরক্ষিত আসনগুলোই নয়, তপশিলি জাতিভুক্ত এবং সাধারণ আসনগুলোতে যেখানে জনজাতি ভোটাররা রয়েছেন সেখানেও তিপ্রা মথার ভোট কমিউনিস্টদের হতাশ করেছে। একইভাবে বাঙালি ভোটারদের কাছেও পরিত্যক্ত হয়েছে সিপিএম। এর মূল কারণ ৫ বছরের জনসংযোগহীনতা। যা সিপিএমকে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখানে বিরোধী দলনেতার পদটি পর্যন্ত বুবাগ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ভোটের প্রচারে বারবার বুবাগ্রা দাবি করেছিলেন, ত্রিপুরার পরবর্তী ত্রিশঙ্কু বিধানসভায় ‘কিং মেকার’ হবে তিপ্রা। ভোটের ফল বলছে, ৬০ সদস্যের বিধানসভায় ৩২টিতে জিতে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সুতোর ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় ‘স্বপ্নপূরণ’ হয়নি প্রদ্যোতের।

যদিও সূত্রের খবর, মানিক সাহার সরকারকে ‘নিরাপদ’ করতে ইতোমধ্যেই তিপ্রার সঙ্গে জোটের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার বার্তা পাঠিয়েছে বিজেপি। ত্রিপুরায় এবার ৪২টি আসনে লড়ে ১৩টিতে জিতেছে তিপ্রা। পেয়েছে ২০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট। জনজাতি এলাকার পাশাপাশি বাঙালি অধ্যুষিত বেশ কিছু আসনেও নজরকাড়া ভোট পেয়েছে তারা। ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি তথা রাজপরিবারের বংশধর প্রদ্যোত বিক্রম ২০২১ সালের গোড়ায় জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকার রক্ষার দাবিতে তিপ্রা ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স বা তিপ্রা মথা দল গড়েছিলেন। পাশে পেয়েছিলেন আশির দশকের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বিজয় রাঙ্খলকে। দলের জনভিত্তির প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১ সালের এপ্রিলে, ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল (এডিসি) এর নির্বাচনে। বিভিন্ন আদিবাসী বা জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তৈরি তিপ্রা মথা এডিসির ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। বাকি ৯টি আসন মিলিতভাবে পায় বিজেপি এবং তাদের জোটসঙ্গী জনজাতি আইপিএফটি।

গত ১ জানুয়ারি আইপিএফটির প্রধান তথা জোট সরকারের মন্ত্রী এনসি দেববর্মার মৃত্যুর পর কার্যত নেতৃত্বহীন হয়ে পড়া দল তিপ্রার মিশে যাওয়ার জন্য আলোচনা শুরু করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা ফলপ্রসূ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিজেপির সঙ্গে তিপ্রার সমঝোতার কথাও হয়। কিন্তু বিধানসভা ভোট ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রের পক্ষে প্রদ্যোতের দাবি মেনে বৃহত্তর তিপরাল্যান্ড গঠনের বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রদ্যোত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট জানিয়েছেন, বর্তমান ত্রিপুরা রাজ্য ভেঙে পৃথক বৃহত্তর তিপরাল্যান্ড রাজ্য চান তারা। যা, আয়তনের দিক থেকে হবে ভারতের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম। ২০১১ সালের জনগণনা রিপোর্ট তুলে ধরে তার দাবি, বাঙালিদের সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে ত্রিপুরার আদি বাসিন্দা জনজাতিরা নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ওই জনগণনা রিপোর্ট বলছে, উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যের মোট ৩৬ লাখ ৭৪ হাজার নাগরিকের মধ্যে বাঙালি ২৪ লাখ ১৪ হাজার। অন্যদিকে, জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ৮ লাখ ৮৭ হাজার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App