×

আন্তর্জাতিক

চীন-মার্কিন বৈরী সম্পর্ক আরো অবনতির আশঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২২ এএম

চীন-মার্কিন বৈরী সম্পর্ক আরো অবনতির আশঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে অবস্থান করা চীনের রহস্যজনক বেলুন নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরেক দফা অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীন স্বীকার করেছে, সেটি তাদের একটি বেসামরিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষক বেলুন, যা তার নির্ধারিত পথ থেকে সরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে যাওয়ায় তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সন্দেহ করছেন, এটি একটি চীনা নজরদারি বেলুন। এ ঘটনায় নির্ধারিত চীন সফর বাতিল করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। এদিকে চীনের ওপর নজরদারি বাড়াতে ফিলিপাইনে সম্প্রতি আরো ৪টি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের সুযোগ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ান থেকে মাত্র ২০০ মাইল দূরে অবস্থিত ফিলিপাইনে নতুন করে মার্কিন সামরিক শক্তি বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়াকে অনেকটাই সামরিক কৌশল হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মার্কিনি এই উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বেলুনটি কি পথ হারিয়ে এসেছে : যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার বিলিংস শহরের আকাশে গত বুধবার দেখা যাওয়ার আগে চীনা বেলুনটি আলাস্কার অ্যালেউটিয়ান দ্বীপপুঞ্জ এবং কানাডার মধ্য দিয়ে উড়ে এসেছে। এ ধরনের বেলুন সাধারণ হিলিয়াম গ্যাসে ভরা বেলুন হয়ে থাকে। এটি আকাশের অনেক উঁচুতে উড়তে সক্ষম হয়। বেলুনের নিচের অংশে একটি সৌরশক্তির প্যানেল থাকে, যা থেকে বেলুনটি পরিচালনার শক্তি জোগানো হয়। এর নিচেই ক্যামেরা, রাডার, সেন্সর এবং যোগাযোগের সরঞ্জামগুলো থাকে। চীন দাবি করেছে যে, ওয়েস্টারলিস বাতাসে বেলুনটিকে তার নির্দিষ্ট পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। বিবিসি ওয়েদারের সিমন কিং বলেছেন, চীন এবং উত্তর আমেরিকার মাঝে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে যে বাতাস বয়ে থাকে, তাকে বলা হয় ওয়েস্টারলিস। এটা সাধারণত পশ্চিমে তৈরি হয়ে পূর্ব দিকে বয়ে যায়। গত কয়েক দিনে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ফিট উচ্চতায় বাতাসের গতিবেগ হতে পারে ঘণ্টায় ১৫০ মাইল (২৪০ কিলোমিটার) বা তার চেয়ে বেশি। ওই উচ্চতায় বাতাসের এ রকম গতিবেগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি বলেন, গত কয়েক দিন ধরে সেখানে বাতাসের যে গতিবেগ রয়েছে, তাতে বেলুনটিকে আলাস্কার উপর দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কানাডা হয়ে মন্টানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সিমন কিং বলেন, বেশির ভাগ ওয়েদার বেলুন এক লাখ ফুট উচ্চতায় ওড়ে। কয়েক ঘণ্টা পরে সেটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো প্যারাসুটের মাধ্যমে নিচে নেমে আসে। কিন্তু এটার মতো এতদিন ধরে এ রকম একটি বেলুনের আকাশে ওড়া বেশ অস্বাভাবিক। স্যাটেলাইট থাকতে বেলুন কেন : বেলুন হচ্ছে গোয়েন্দা নজরদারির সবচেয়ে পুরনো পদ্ধতিগুলোর একটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিসংযোগকারী বোমা হামলা করতে জাপানিরা বেলুন ব্যবহার করেছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও ব্যাপকভাবে নজরদারি করতে বেলুন ব্যবহার করে। স¤প্রতি জানা গেছে, অনেক উঁচুতে উড়ে নজরদারি করতে পারে, পেন্টাগনের নেটওয়ার্কে এ রকম বেলুন যুক্ত করার কথা বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। আধুনিক যে বেলুনগুলো রয়েছে, সেগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে ২৪ থেকে ৩৭ কিলোমিটার (৮০ হাজার ফুট থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ফুট) উঁচুতে উড়তে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্যাটেলাইট বা ড্রোনের তুলনায় বেলুনের বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। এটি কম ব্যয়বহুল এবং খুব সহজেই মোতায়েন করা যায়। স্যাটেলাইট তার নিজের কক্ষপথেই ঘুরতে থাকে। কিন্তু বেলুন যে কোনো জায়গায় পাঠানো যায়। ড্রোনের তুলনায় এটি অনেক ধীরগতিতে ওড়ে বলে অনেক সময় নিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে নজরদারি করা সম্ভব। লাতিন আমেরিকার আকাশেও চীনা বেলুন : যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা ‘গোয়েন্দা’ বেলুনের উপস্থিতি নিয়ে দুই দেশের উত্তেজনার মধ্যেই শুক্রবার মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানায়, শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, লাতিন আমেরিকার আকাশেও উড়ছে সন্দেহজনক চীনা গোয়েন্দা বেলুন। পেন্টাগনের মুখপাত্র প্যাট রাইডার সাংবাদিকদের বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো লাতিন আমেরিকার আকাশেও সন্দেহজনক বেলুন উড়ছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। আমরা ধারণা করছি, এটি আরেকটি চীনা গোয়েন্দা বেলুন।’ তবে লাতিন আমেরিকার কোন দেশের ওপর কিংবা কবে থেকে বেলুনটি উড়ছে, কবে সেটি শনাক্ত করা হয়েছে, সেসব বিষয়ে কিছুই জানায়নি পেন্টাগন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন সফর স্থগিত : ‘বেলুনকাণ্ডের’ জেরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন তার দুদিনের চীন সফর স্থগিত করেন। আজ রবিবার ও আগামীকাল সোমবার এই সফর হওয়ার কথা ছিল। এবারের সফরে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ, তাইওয়ান ইস্যু ও করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, কয়েক বছরের মধ্যে চীনে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে এটি প্রথম শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হতে পারত। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি এ বৈঠকের অনুকূলে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমায় চীনা নজরদারি বেলুন নিয়ে বেইজিংয়ের কাছ থেকে খোলাখুলি ব্যাখ্যা না পাওয়ায় সফর স্থগিত করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পরামর্শে সফর স্থগিত করার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্লিংকেন। চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে শুক্রবার টেলিফোনে কথা বলেন ব্লিংকেন। এ সময় তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনা গোয়েন্দা বেলুনের অনুপ্রবেশ দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। এটা যুক্তরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি কাজ। ‘বেলুনকাণ্ডের’ জেরে পরে দুঃখ প্রকাশ করেছে বেইজিং। দেশটির দাবি, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো এ বেলুন বাতাসে ভেসে পথ ভুল করে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মূলত আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য বেলুনটি আকাশে ওড়ানো হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট পথে না গিয়ে সেটি যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছে। দেশটির আকাশসীমায় অনাকাঙ্খিতভাবে বেলুনটি উড়ে যাওয়ার এ ঘটনার জন্য বেইজিং অনুতপ্ত। চীনের ওপর নজরদারি বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র : চীনের ওপর নজরদারি বাড়াতে ফিলিপাইনে আরো ৪টি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের সুযোগ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার দুই দেশের প্রতিরক্ষাপ্রধানরা এ তথ্য জানান। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কার্লিটো গালভেজ ম্যানিলায় ফিলিপাইনের সামরিক সদরদপ্তরে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ২০১৪ উন্নত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির অধীনে আরো ৪টি স্থান ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হবে। এর আগে গত সপ্তাহে গত ৭০ বছরের মধ্যে এই প্রথম ফিলিপাইনের পূর্ব উপকূলে গুয়ামে ‘ক্যাম্প ব্লেজ’ নামের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে মেরিন সেনা। এই ঘাঁটিতে আগামীতে ৫ হাজার সেনা নিয়োগের প্রত্যাশাও রয়েছে মার্কিন প্রশাসনের। চীন এর সমালোচনা করে বলেছে, ফিলিপাইনে সামরিক ঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং উত্তেজনা বাড়িয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মার্কিনি এই উদ্যোগে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণে সামরিক শক্তি প্রয়োগে চীন বিরত থাকলেও বাইডেন প্রশাসনের এমন পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ। শির অনাকাঙ্খিকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে না : ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড খানিকটা দমিয়ে দিলেও তাইওয়ান নিয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আকাক্সক্ষাকে খাটো করে দেখা উচিত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস। ওয়াশিংটনে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গত বৃহস্পতিবার তিনি এ মন্তব্য করেন। বার্নস বলেন, শি তার বাহিনীকে ২০২৭ সালের মধ্যে স্বশাসিত তাইওয়ানে আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তা জেনেছে। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি ২০২৭ বা অন্য কোনো বছরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন, তবে এটি তার মনোযোগ ও আকাক্সক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সিআইএর মূল্যায়ন হচ্ছে, আমি তাইওয়ান বিষয়ে প্রেসিডেন্ট শির আকাক্সক্ষাকে খাটো করে দেখি না। ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর অল্প কিছুদিন আগেই মস্কো ও বেইজিং তাদের মধ্যে ‘সীমাহীন বন্ধুত্বের’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করে, তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কও দিন দিন জোরদার হচ্ছে, যা এরই মধ্যে পশ্চিমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়া তার প্রতিবেশী দেশে অভিযান শুরুর পর চীনেরও তাইওয়ানে একই ধরনের অভিযানে নামার সম্ভাবনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, বেইজিং তাইওয়ানকে তার বিচ্ছিন্ন প্রদেশ মনে করে। মূল ভূখণ্ডে দ্বীপটিকে একীভূত করতে বলপ্রয়োগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা। অন্যদিকে তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন দেশ মনে করে; আর যুক্তরাষ্ট্র মুখে ‘এক চীন’ নীতিতে বিশ্বাসী হলেও তাইওয়ানকে রক্ষায় সামরিক সহযোগিতা দিতে তারা আইনিভাবেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সিআইএর এই পরিচালকের বক্তৃতার সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে কয়েক দিন ধরে চীনা নজরদারি বেলুন ওড়ার খবর আসে। এর ধ্বংসাবশেষ নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে এই ভয়ে ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা বেলুনটিকে গুলি করে ভূপাতিত করতেও নিষেধ করেছেন। বার্নস তার বক্তৃতায় এই প্রসঙ্গে কিছু না বললেও চীনকে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হওয়া ‘সর্ববৃহৎ ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মাত্রাগত দিক থেকেই অনন্য। সব খাতে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে, কেবল সামরিক বা আদর্শগতভাবেই নয়, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তি, সাইবার জগৎ থেকে শুরু করে মহাকাশ, সর্বত্র। বিশ্বব্যাপী এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে ধরন, তাতে এটি সোভিয়েতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়েও তীব্র হয়ে যেতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App