×

স্বাস্থ্য

প্রস্তুতির ঘাটতিতে পিছিয়ে শিশুদের করোনা টিকাদান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৫৮ এএম

প্রস্তুতির ঘাটতিতে পিছিয়ে শিশুদের করোনা টিকাদান

প্রতীকী ছবি

প্রথম ঘটনাটি গাইবান্ধার সদর উপজেলার কুপতলা গ্রামের আজিমনাহার বিদ্যাপীঠের। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশু আছে ১২৫ জন। দেশব্যাপী ৫-১১ বছর বয়সীদের কোভিড-১৯ টিকা দেয়ার সিদ্ধান্তের পরই জন্মনিবন্ধন নিয়ে নিবন্ধন করা, টিকার প্রয়োজনীয়তা ও টিকা নিলে কী ধরনের প্রস্তুতি থাকতে হয়- এ বিষয়ে অভিভাবক ও শিশুদের সচেতন করার কাজ শুরু করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। গত বুধবার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিকা দেয়া হবে, এমন কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। সেই অনুযায়ী প্রস্তুতিও নেয়া হয়। কিন্তু মঙ্গলবার সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জানানো হয় টিকা কার্যক্রম হচ্ছে না। কারণ হিসেবে বলা হয়- টিকার স্বল্পতা।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ঢাকার। বাসচালক হাসান মিয়া থাকেন শনির আখড়ায়। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও হাসান মিয়ার ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নেই। এতদিন সমস্যা না হলেও বিপত্তি বাধে সাড়ে ৫ বছর বয়সী সিফাতকে টিকা দেয়ার সময়। সিফাতের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন নেই। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, ছেলেমেয়ের জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে করতে হলে বাবামায়ের জন্ম নিবন্ধনও করাতে হবে। ছেলের জন্মনিবন্ধন করতে সিটি করপোরেশনে গেলেও ভোগান্তিতে পরে মাঝপথে ক্ষান্ত হন হাসান মিয়া। বলেন, এই কাজের জন্য টাকা চায়। এক টিকার জন্য এত ঝামেলা? টিকা নিয়েইবা লাভ কী? টিকা নিয়েওতো মানুষের করোনা হচ্ছে।

তৃতীয় ঘটনাটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর সদরের। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে শিশুদের কোভিড-১৯ টিকা দেয়া হচ্ছে- তা জানেন না ওই এলাকার বাসিন্দা অমল সূত্রধর (৪৫)। পেশায় কাঠমিস্ত্রীর অমল বলেন, ‘আমিতো শুনছি ঢাকার বাচ্চাদের টিকা দিছে। গ্রামেও টিকা দেয় তা তো জানি না। মাইকিং হয় নাই। আমাদের যখন টিকা দিছে তখন তো মাইকিং হইছে। আমার মেয়ে তো ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এমন কোনো খবর তো শুনি নাই।’

দেশের জেলা উপজেলা পর্যায়ে ৫-১১ বছর বয়সী শিশুদের কোভিড-১৯ টিকা কার্যক্রম শুর হয় ১১ অক্টোবর। এর আগে ১১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেরে বাংলা নগরের আবুল বাশার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৭ শিক্ষার্থীকে পরীক্ষামূলকভাবে টিকা দিয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়। শিশুদের দেয়া হচ্ছে বিশেষভাবে তৈরি ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা।

দেশব্যাপী এই কর্মযজ্ঞ শুরু হলেও এর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় যেমন- জন্মনিবন্ধন প্রাপ্তি সহজীকরণ বা এর বিকল্প ব্যবস্থা আগে থেকেই রাখা, প্রচার প্রচারণা, অভিভাবকদের সচেতন করার মতো কাজগুলো করা হয়নি। ফলে কাক্সিক্ষত যে লক্ষ্যমাত্রা তা নির্ধারিত সময়ে অর্জিত হবে কিনা- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কিছু সমস্যা থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনো সমস্যা হবে না। আর এই কাজের সঙ্গে যুক্ত অংশীজনের বক্তব্য, বিষয়টি নিয়ে মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জাতীয় টিকা পরামর্শক কমিটির (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল এডভাইজরি গ্রুপ-নাইট্যাগ) সদস্য অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদও মনে করেন এত বড় একটি কর্মযজ্ঞে যে ধরনের প্রস্তুতি নেয়া দরকার ছিল তা হয়নি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, যে কোনো কাজ তা ছোট হোক বা বড় হোক প্রস্তুতিটা যথাযথভাবে নিতে হয়। সেই প্রস্তুতির মধ্যে প্রচার প্রচারণা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ওই সেবাটি পেতে যে বিষয়গুলো প্রয়োজন হবে সেটি পেতেও যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে; সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নেয়া। জাতীয় পর্যায়ে যখন কয়েক কোটি শিশুকে টিকা দেয়া হবে তাহলে বড় প্রস্তুতি নেয়া উচিত ছিল। যে কাজে আমরা ভালো করতে পারি সেই কাজে প্রস্তুতিটা আমরা ভালো করে কেন নেব না?

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) সংক্রামক ব্যাধি বিভাগের পরামর্শক ডা. তাজুল ইসলাম এ বারি মনে করেন, নিম্নমুখী সংক্রমণ, করোনায় শিশুদের কম সংক্রমণ ও মৃত্যু, করোনা টিকা নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা, প্রচারের অভাবে শিশুদের টিকা নেয়ার হার কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইপিআই কর্মসূচির সাবেক এই পরিচালক ভোরের কাগজকে বলেন, টিকা নেয়ার পরও অনেকে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে; ফলে টিকা কার্যকর নয় বলে কেউ কেউ মনে করছেন। করোনার সংক্রমণ এখন নিম্নমুখী। শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসে সংক্রমিতের হার কম। সংক্রমিত হলেও সেটি মারাত্মক হচ্ছে না, লক্ষণও বোঝা যাচ্ছে না, মৃত্যু হারও কম। যার কারণে অভিভাবকরা আগ্রহী হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও লাইন ডিরেক্টর (এমএনসিএএইচ) এবং কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক মনে করেন কিছু সমস্যা থাকলেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু সমস্যা আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের টাইমফ্রেম অনুযায়ী কাজ করছে। ছুটির দিনে (শুক্র, শনি) স্কুলে টিকা কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এছাড়া চলতি মাসের ১ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূজার ছুটি ছিল। কোনো স্কুলে পরীক্ষা থাকলে সেদিন কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এছাড়া স্কুলে কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানও থাকে।

সেদিনও টিকা দেয়া যায় না। ফলে কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা একটা প্ল্যান করেছি। এখন আমরা ১২ কর্ম দিবস কাজ করব। এরপর যে এলাকায় স্কুলের সব শিশুদের টিকা দেয়া হয়ে যাবে তখন যে শিশুরা স্কুলে যায় না বা ঝড়ে পড়েছে কিংবা বস্তিতে থাকে তাদের জন্য একদিন ওই এলাকার কমিউনিটিতে ক্যাম্পেইন হবে।

টিকার সংকট আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, টিকার একটি ফ্লাইট ১৭ অক্টোবর আসার কথা থাকলেও কিছু জটিলতায় তা ২০ তারিখ এসেছে। আমাদের পর্যাপ্ত টিকা আছে। চিন্তুার কোনো কারণ নাই।

নির্ধারিত সময়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি। এ পর্যন্ত স্কুলের ৩৮ লাখ শিশু টিকা পেয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার ৪০ শতাংশ পূরণ হয়েছে। আর কার্যক্রম চলবে চলতি মাস জুড়েই। আগামী সপ্তাহেই এই হার আরো অনেক বেড়ে যাবে।

শিশুদের এই কোভিড টিকা কার্যক্রমে সহায়তা করছে জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। শিশুদের টিকা গ্রহণের হার কেমন- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, শিশুদের টিকা কার্যক্রম আগে শুরু হলেও জেলায় এই কার্যক্রম সম্প্রতিই শুরু হয়েছে। কাজেই এখনই এই কার্যক্রম সম্পর্কে মূল্যায়ন করা যাবে না। আগামী সপ্তাহের মাঝামাঝিতে গিয়ে এই মূল্যায়ন করা যাবে। গণটিকা কার্যক্রম কমিউনিটিভিত্তিক হয়েছে। তখন প্রতিটি ওয়ার্ডেই এই টিকা কেন্দ্র হয়েছে। শিশুদের টিকা কার্যক্রম কিন্তু স্কুলভিত্তিক। যখন যে স্কুলে কার্যক্রম চলবে তখন সেই স্কুলে বাচ্চারা টিকা পাবে। এখানেই পার্থক্যটা।

জন্মনিবন্ধন জটিলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরুতে জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলেও পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় থেকে কিন্তু বলা হয়েছে যার জন্ম নিবন্ধন নেই তাকেও যেন তালিকা করে টিকা দেয়া হয়। সুতরাং এই বিষয়গুলো সমাধান করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App