×

ফিচার

আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০১৭, ০১:২৩ পিএম

প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী ঘুমিয়ে গেলেন। যতই ডাকি তিনি আর সাড়া দেবেন না। চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার গাওয়া গানে ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’- এ কথাগুলো তার জীবনের জন্যই অবশেষে সত্যি হলো। তার ভক্তদের এই আকুতির জবাব কোনো দিনই জানা যাবে না। সারাটি জীবন ভক্তরা তাকে যেভাবে আগলে ধরে ছিলেন, সব বাঁধন খুলে চলে গেলেন এই বংশীবাদক। কোনো দিনই চোখ মেলে আর তাকাবেন না তিনি। ‘তুমি আমি জনম ভরা, ছিলাম মাখামাখি,আজ কেন হইলে নীরব, মেলো দুটি আঁখি।’- এ রকম অনেক গান গেয়ে চোখ না মেলার কথা ভক্তদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বারী সিদ্দিকী। তার চির বিদায়ে চোখের জলে বুক ভিজিয়েছেন হাজারো ভক্তরা। অনেক মানুষকে কাঁদিয়ে বিদায় নিলেন এ গুণীশিল্পী। তার শূন্যতা আর পূরণ হওয়ার নয়। ঢাকার একটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার ও বাঁশিবাদক। হৃদরোগ ছাড়াও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। গত ১৭ নভেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হলে বারী সিদ্দিকীকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক আবদুল ওয়াহাবের তত্ত্বাবধানে সাত দিন আইসিইইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হলেও তার অবস্থার অবনতি ঠেকানো যায়নি। মূলত লোকগান ও আধ্যাত্মিক ধারার গানের জন্য পরিচিত এই শিল্পী গত শতকের শেষ দিকে সারা দেশের শ্রোতাদের কাছে পৌঁছান কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে। চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে তার দরদি কণ্ঠের বেশ কিছু আবেগমাখা গান দারুণ জনপ্রিয়। ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর ভাটি অঞ্চলের এই জেলাতেই আবদুল বারী সিদ্দিকীর জন্ম। পরিবারেই শৈশবে তার গান শেখার হাতেখড়ি হয়। কিশোর বয়সে নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন বারী। পরে ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ বহু গুণীশিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য পান। একটি কনসার্টে বারী সিদ্দিকীর গান শুনে তাকে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন ওস্তাদ আমিনুর রহমান। পরে ছয় বছর ধরে চলে সেই প্রশিক্ষণ। সত্তরের দশকে নেত্রকোনা জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী সিদ্দিকী। পরে ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রপদী সঙ্গীতের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন। এক সময় বাঁশির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং উচ্চাঙ্গ বংশীবাদনের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পন্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন বারী। দেশে ফিরে লোকগানের সঙ্গে ধ্রপদী সঙ্গীতের মিশেলে গান শুরু করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে বাঁশি বাজিয়ে বেড়ানোর মধ্যেই ১৯৯৩ সালে হুমায়ূূন আহমেদের জন্মদিনে তার বাসায় এক অনুষ্ঠানে বাঁশি শোনাতে যান বারী সিদ্দিকী। সেই অনুষ্ঠানে বারীর বাঁশির চেয়ে তার কণ্ঠে গাওয়া রশিদ উদ্দিন বাউল আর উকিল মুন্সির গানই বেশি পছন্দ হয় হুমায়ূনের। পরে লেখক হুমায়ূনের আগ্রহেই বারীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়,’ ‘পুবালি বাতাসে’ গানগুলো রেকর্ড করা হয়। টেলিভিশনে ‘রঙের বাড়ই’ নামে একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি প্রচার করা হলে বারী সিদ্দিকী পৌঁছে যান সারা দেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে। ১৯৯৯ সালে হুমায়ূন আহমেদের রচনা ও পরিচালনায় শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ছয়টি গানে কণ্ঠ দেন বারী সিদ্দিকী। গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘শুয়াচান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি’, ‘পুবালি বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘ওলো ভাবিজান নাউ বাওয়া’ এবং ‘মানুষ ধরো মানুষ ভজো’। ‘শুয়া চান পাখি’ গানটি সে সময় তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ওই বছরই জেনেভায় বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে যোগ দেন বারী সিদ্দিকী। পরে রূপকথার গল্প, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ, ও আমার দেশের মাটিসহ আরও কয়েকটি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাকে গেয়েছেন এই শিল্পী। তার কণ্ঠের গান নিয়ে ডজনখানেক অ্যালবামও প্রকাশিত হয়েছে। বারী সিদ্দিকী ১৯৮৬ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে। বারী সিদ্দিকীর দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে সাব্বির সিদ্দিকী, মেয়ে এলমা সিদ্দিকী এবং ছোট ছেলে বিলাস সিদ্দিকী। ১৯৮০ সালে বারী সিদ্দিকী পেশাগতভাবে বাঁশি বাজানো শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম বিটিভিতে ‘সৃজন’ অনুষ্ঠানে বাঁশি বাজান। বারী সিদ্দিকী ‘মাটির পিঞ্জিরা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ‘পাগলা ঘোড়া’ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তবে অভিনয় করতেন নিতান্তই অনুরোধে এবং শখের বশে। বারী সিদ্দিকীর শেষ ইচ্ছা নেত্রকোনার কারলি গ্রামের বাউল বাড়িতে সমাহিত করা হয় বারী সিদ্দিকীর মরদেহ। এই শিল্পীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সেখানে দাফন করা হয় বলে জানান বারী সিদ্দিকীর ছেলে সাব্বির সিদ্দিকী। তিনি বলেন, বাবা আমাদের বলে গেছেন তার শেষ ইচ্ছার কথা। মৃত্যুর পর ‘বাউল বাড়িতেই’ যেন তাকে সমাহিত করা হয়। বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে বাউল বাড়িতে সমাহিত করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বরেণ্য শিল্পী বারী সিদ্দিকী। সকালে গোসল ও কাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে মরদেহ সকাল ৭টায় ধানমন্ডি ১৪/এ সড়কে তার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জানাজা। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবনে দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বারী সিদ্দিকীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নেত্রকোনায়। বাদ আসর নেত্রকোনা সরকারি কলেজ মাঠে তৃতীয় জানাজার পর বাউল বাড়িতে তাকে সমাহিত করা হয়। সাব্বির সাদ্দিকী আরো বলেন, বাবার আরেকটি ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গেল। শেষ একটা কাজ করে যেতে পারেননি। শিশুদের জন্য তিনি একটি আশ্রম তৈরি করতে চেয়েছিলেন। গ্রামের বাড়িতে সেই আশ্রম তৈরিতে সবাই সহযোগিতা করবেন, এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি। শহীদ মিনারে নিয়ে জাতির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন কেন নয়? সংস্কৃতি অঙ্গনের গুণী ব্যক্তিত্বদের প্রয়াণের পর তাদের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনা হয় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এটি আয়োজন করে থাকে। কিন্তু বারী সিদ্দিকীর মরদেহ কেন শহীদ মিনারে নেয়া হলো না? বিষয়টি নিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, বারী সিদ্দিকী লোকগানের শিল্পী, মাটির গানের শিল্পী। তার মতো শিল্পীকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। তিনি আরো বলেন, বারী সিদ্দিকী রাত আড়াইটায় মারা গেছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে এই খবর জেনেছি। তার পরিবার কিংবা সঙ্গীতশিল্পীদের কেউ এই খবর আমাদের জানায়নি। খবর শুনেই সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে গিয়ে তার জানাজায় অংশ নিয়েছি। সেখানে তার ছেলে আমাদের জানিয়েছে বাদ আসর নেত্রকোনায় তাকে দাফন করা হবে। এটা পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের তো কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা এমন একজন গুণী শিল্পীকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এদিকে বারী সিদ্দিকীর ছেলে সাব্বির সিদ্দিকী বলেন, বাবা এক সপ্তাহ ধরে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। তার মৃৃত্যুর পর দাফনের জন্য আমরা দেরি করতে চাইনি। মরদেহ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ ও বিটিভি ভবনে জানাজার পর নেত্রকোনায় নিয়ে গেছি। ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছা বারীর গান কণ্ঠের জাদুকরী ক্ষমতা ছিল বারী সিদ্দিকীর। সুরের আবেশে মুগ্ধ করেছেন কোটি মানুষকে। তার গান শুনতে ব্যাকুল হয়ে থাকতেন হাজারো মানুষ। থেমে গেছে বারী সিদ্দিকীর সেই কণ্ঠ। আর কোনোদিন সরাসরি গান শোনাবেন না বারী সিদ্দিকী। চিরনিদ্রায় চলে গেলেন ‘শুয়াচান পাখি’-খ্যাত এই শিল্পী। তার গানের এমনই শক্তি ছিল যে ফাঁসির আসামি মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে শুনতে চেয়েছেন বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটি। বারী সিদ্দিকী নিজেই একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে এ কথা জানান। বারী সিদ্দিকী বলেন, একদিন রাত ১০টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফোন আসে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একজন ম্যাজিস্ট্রেট জানান, ‘এক ফাঁসির আসামি তার শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন আপনার কণ্ঠে উকিল মুন্সির লেখা ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়/বন্ধুয়ারে কর তোমার মনে যাহা লয়’ গানটি শুনতে চান।’ আমি তখন রিকশায় ছিলাম। সেখান থেকেই মোবাইলে গানটি গেয়ে শোনাই। এর সত্যমিথ্যা জানি না। তবে এমন অনেক ঘটনা আমার জীবনে আছে। হারমোনিয়ামে গাইতেন না আমি এই পর্যন্ত হারমোনিয়াম ধরে গান গাই না। কারণ হারমোনিয়াম বাজালে আবেগের একটা অংশ বাজনার দিকে চলে যাবে।’ গণমাধ্যমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘এটা অন্য শিল্পীদের বেলায় হবে কি না আমি জানি না। গাওয়ার সময় গানের একেকটা শব্দের ভেতর প্রবেশ করতে হয়। আমার প্রতিটা গানে যেন আমার নিজের জীবনেরই মর্ম বেদনা প্রকাশ পায়। যতটুকু প্রকাশ পাওয়া দরকার ততটুকু যদি প্রকাশ না পায় তাহলে সেটা ভালো লাগবে না। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি।’ নিজের গানকে ‘আত্মার গান’ বলে উল্লেখ করেন বারী সিদ্দিকী। পারিশ্রমিকের অঙ্ক দেখে চমক ১৯৯৯ সালে জেনেভায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাঁশি সম্মেলনে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বারী সিদ্দিকী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪৫ মিনিট বাঁশি বাজিয়েছিলেন তিনি। ওই সময়ের কিছু ঘটনা বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) এক অনুষ্ঠানে বর্ণনা করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পারিশ্রমিকের অঙ্ক দেখে চমকে যাওয়া। অনুষ্ঠান শেষে রাতে যখন পারিশ্রমিকের কাগজে স্বাক্ষর করতে বলা হয়, বারী সিদ্দিকী ও তার স্ত্রী বিব্রত হন এই ভেবে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। মাত্র ৪৫ মিনিটের অনুষ্ঠানের জন্য তাকে দেয়া হয়েছিল ৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা! তার স্ত্রী বলেও বসেনÑ আয়োজকদের ডেকে বলতে তাদের কোথাও ভুল হয়েছে, তিনি এত টাকা পাওয়ার যোগ্য নন! বারী সিদ্দিকীর মতে, আয়োজকদের ভুল হওয়ার কথা না। পরদিন তার জন্য নিযুক্ত দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার পারিশ্রমিকের অঙ্ক, স্বাক্ষর সব ঠিক আছে তো? দোভাষী জানান, সবকিছু ঠিক আছে। বারী সিদ্দিকী আরো জানান, তাকে থাকতে দেয়া হয়েছিল হোটেলের সেই রুমটায় যেখানে বিখ্যাত ভারতীয় বংশীবাদক পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া জেনেভায় গিয়ে নিয়মিত থাকতেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App