×

বিনোদন

অনন্যা: বিরুদ্ধ-স্রোতের এক নারীর গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৪৯ পিএম

অনন্যা: বিরুদ্ধ-স্রোতের এক নারীর গল্প
অনেকদিন ধরে আমরা একটা অভিযোগ শুনে আসছি— বাংলাদেশের মানুষ দেশি নাটক-সিনেমা দেখে না, ভারতীয় সিরিয়ালে বুঁদ হয়ে থাকে। এ অভিযোগের সত্যতা একসময় ছিল না, সে কথা বলার উপায় নেই। তবে গত কয়েক বছরে দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ, অর্থাৎ সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা বাংলাদেশি নাটক পছন্দ করছে। টেলিভিশনের দর্শকের সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান হাতের কাছে না থাকায় (আদৌ এই পরিসংখ্যান কোথাও আছে কি না কে জানে!) হিসেব করতে হচ্ছে ইউটিউবের ‘ভিউ’ দিয়ে। বাংলাদেশি একেকটা নাটকের ভিউ অনেক। কলকাতাসহ ভারতের অনেক রাজ্যে থাকা বাঙালিরা বাংলাদেশি নাটক দেখছেন, প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জানা যায়, বাংলাদেশের মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, আফরান নিশো, মেহজাবীন, তাসনিয়া ফারিণ, তানজিন তিশাসহ অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীরই প্রচুর ভক্ত আছেন কলকাতায়। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির ফলে ভারতীয় অনেক অভিনেতা যেমন বাংলাদেশের নাটক সিনেমায় অভিনয় করছেন, তেমনি বাংলাদেশের অভিনেতারাও দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন কলকাতাসহ অন্যান্য অঞ্চলের নাটক-সিনেমায়। যদিও আমাদের দেশে নির্মিত নাটকের কয়টি ঠিক শিল্পোত্তীর্ণ, তা হাতে গুনে বলা যায়। প্রচুর নাটক এখানে নির্মিত হলে এবং সেসব নাটকের ‘ভিউ’ অনেক বেশি হলেও নাটকগুলোতে গল্প বলতে গেলে নেই। হালকা চালের নাটকই আসলে সিংহভাগ। সম্ভবত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকেন বলে নাটকগুলোতে ভিউ হয়। নামকরণের বেলাতেও নির্মাতারা চটকদার শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেন। দর্শকের শিল্পমান কমে যাওয়াও এসব নাটকের ভিউ বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ হতে পারে। প্রায় প্রতিটি নাটকেরই পাত্র-পাত্রী সংখ্যা থাকে চার বা সাকুল্যে পাঁচজন। বেশিরভাগ নাটকের পাত্র-পাত্রীরা ঘর থেকে বেরই হন না। অর্থাৎ আউটডোরের দৃশ্য প্রায় থাকেই না। বলাই বাহুল্য, নাটকের বাজেট কমে যাওয়ায় পরিচালকেরা একটা শুটিং স্পটেই কাজ চালিয়ে নেন। আগে যেমন আমাদের নাটকগুলোর ভিত্তি ছিল গল্প, এখন আর তা নেই। অর্থাৎ আগে গল্পকে কেন্দ্র করে নাটক নির্মিত হতো, এখন বাজেট, তারকা এবং দশর্ক চাহিদার ওপর নির্ভর করে নাটকের গল্প সাজানো হয়। পুরো ঘটনাই আসলে উল্টে গেছে। সুতরাং ভিউ বেশি বলেই যে ভালো মানের নাটক নির্মিত হচ্ছে, সে কথা বলা যাবে না। বরং বিটিভি যুগের তুলনায় নাটকের মান একেবারেই পড়ে গেছে। যদি ভালো নাটক আর বাজে নাটকের অনুপাত বিচার করা হয়, এখনকার অধিকাংশ নাটকই মানহীন। তবু এসবের মধ্যেও আমাদের দেশে ভালো নাটক নির্মিত হয় না, সেটা বলা অনুচিত। সমস্যা হলো এত বাজে নাটকের মধ্যে ভালো নাটক খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে কখনও কখনও। নিতান্তই কেউ রিভিউ না দিলে ভালো নাটক খুঁজে পেতে অনেক দেরি হয়। নির্মাতারা ভালো নাটক বানাতে আগ্রহী নন, তারা বিক্রয়যোগ্য নাটক বানাতে আগ্রহী। ফলে এই আকালের বাজারে ভালো নাটক দেখতে পারা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাই বটে! তেমনই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল গত কয়েক দিন আগে। দেখলাম মোস্তফা কামাল রাজের পরিচালনায় নাটক ‘অনন্যা’। নাম শুনেই বোঝা যায় নাটকটি নারী চরিত্র প্রধান। সেই কেন্দ্রীয় চরিত্রটিতে অভিনয় করেছেন হালের তারকা অভিনেত্রী মেহজাবীন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে কজন ভালো অভিনেত্রী আছেন, তাদের মধ্যে মেহজাবীন প্রথম দিকেই থাকবেন। এই নাটকে তাঁর অভিনয় সাবলীল। চরিত্রকে নিজের মধ্যে ধারণ করে পরিণতি পর্যন্ত এগিয়েছেন। সমকালীন অন্যান্য নাটকের তুলনায় এগিয়ে রাখতে হবে নাটকটিকে। মাতৃত্ব ও ক্যারিয়ারসহ নারীর সামাজিক, পারিবারিক ও অন্যান্য সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে। মূল চরিত্র অনন্যার মা অসুস্থ, সে কথা আমরা শুরুতেই জানতে পারি। ফলে সন্তান পালনের ক্ষেত্রে তিনি যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছেন, তা নাটকের শুরুতেই স্পষ্ট হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মজীবী মা-বাবার সন্তানের দায়িত্ব নানি-দাদিরা খানিকটা নেন। এতে নারীটিকে তার ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয় না। অনন্যা, তাঁর বর মারুফ, আর মারুফের মা থাকেন এক ফ্লাটে। বাচ্চা পালনের ক্ষেত্রে মারুফের মা সাহায্য করার চেষ্টা করেন। কিন্তু সমস্যা বাধে দুজন দুই প্রজন্মের বলে। অনন্যা বাচ্চার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে বলেন কিন্তু তার শাশুড়ি চান সনাতন পদ্ধতিতে বাচ্চা পালন করতে। পুরনো আমলের মূল্যবোধের সঙ্গে সংঘাত হয় নতুন যুগের। পুত্রবধূ হিসেবে অনন্যাকে এই নাটকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং ভদ্র দেখানো হয়েছে। সে কারণে সংঘাতগুলো খুব বেশি দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট-সমস্যার বেশ কিছুটা উঠে এসেছে এ নাটকে। অনন্যার শাশুড়ি তাঁর পুত্রবধূকে যেমন দেখতে চান, তার মধ্যে দিয়েই সমাজের চাওয়াটা প্রতিফলিত হয়েছে। আমাদের সমাজ চাকরিজীবী মেয়েদের কাছেও সর্বোচ্চ সেবাটা চায়। তারা চায় মেয়েরা বাইরে কাজ করবে, সেই সাথে বাড়িতে এসে স্বামীকে নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াবে এবং বাচ্চা পালনের সব দায়িত্বও নেবে। সমাজ মেয়েদের যেভাবে দেখতে চায়, সেটা খুব বাস্তবসম্মত বলার উপায় নেই। নারীর যে নিজের একটা জীবন থাকতে পারে, সেই জীবনে তার কোনো স্বপ্ন থাকতে পারে—এসব চাহিদা আমাদের সমাজ কোনোদিন স্বীকার করেনি। বরং সবার চাহিদামতো হতে হবে নারীকে। এটাই যেন নারীর নিয়তি। সে কারণেই দেখা যায়, সন্তান হওয়ার পর অনেক নারীকে তাদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়। অনন্যাও অনেক চেষ্টা করেন সমস্ত কাজ করে তার ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখার। একদিকে যেমন অফিসের বসের কথা শুনতে হয়, তেমনি বাসায় এসে শাশুড়ির গালমন্দ শুনতে হয় তাকে। অনন্যা খেয়াল করেন, মূল সমস্যাগুলো মিটে যেত, যদি অফিসগুলোতে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকত। কিন্তু অফিসের কর্তাব্যক্তিরা এসব করতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত অনন্যা বাসায় বাচ্চা রাখতে না পেরে বাচ্চাকে অফিসে নিয়ে আসেন। কয়েক দিন আনার পর অভিযোগ করেন সহকর্মীরা। নাটকটিতে যে প্রতিকূলতাগুলো দেখানো হয়েছে, তার সবগুলোই বাস্তব। অনন্যা তার বসকে বলেন, অন্তত একটা রুম যদি ব্যবস্থা করা যায় অফিসের মধ্যে, তাহলে সেখানে মায়েরা তাদের বাচ্চাকে রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারবেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অনন্যা ছেড়ে আসেন অফিস। বলেন, যেখানে তার বাচ্চার জায়গা হয় না, সেখানে তিনিও থাকতে পারেন না। একজন মায়ের বাচ্চার প্রতি চিরন্তন ভালোবাসা ফুটে উঠেছে এই দৃশ্যে। আবার বাসাতেও তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না। চাকরি ছাড়ার পর স্বামী মারুফের আচরণও বেশ বদলে যায়। অনন্যা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে নিয়ে আলাদা থাকার। তারপর শুরু করেন নতুন সংগ্রাম। একসময় সেই লড়াইয়ে জেতেন তিনি। কিন্তু পারিবারিক জীবন ফিরে পান কি না, সেটা অস্পষ্ট। অনন্যার পাশাপাশি আরেকজন কর্মজীবী মায়ের গল্পও ছোট পরিসরে দেখানো হয়েছে নাটকে। অনন্যার বাসার কাজের মেয়েটার বাচ্চার বয়সও এক-দেড় বছর। উপার্জনের বিকল্প না থাকায় ছয় বছর বয়সের বড় মেয়ের কাছে রেখে কাজে আসতে হয় তাকে। অনন্যা নিজে মা হওয়ার পর সমস্যাটি উপলব্ধি করেন এবং কাজের মেয়েটিকে দুটো বাচ্চাসহই আসতে বলেন প্রতিদিন। আমাদের সমাজের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে এ নাটকে। শিল্প-সাহিত্য শুধু বিনোদনের জন্য নয়, সমাজসংস্কারের কিছু দায়ও রয়েছে শিল্পের। এ রকম নাটকে মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়, মানুষ সচেতন হয়। নাটকটি আরও বেশি মানুষ দেখবেন, তাঁদের চিন্তার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবে নাটকটি, এই প্রত্যাশা করি। লেখক: রাহিতুল ইসলাম, লেখক ও সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App