ড. নিয়াজ আহমেদ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেতৃত্বের বিকাশে প্রয়োজন শিক্ষার্থী সংসদ চালু করা
রাফিউজ্জামান লাবীব
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪, ০৯:১৮ পিএম
অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বৈষম্যেবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বশেষ ১ দফা দাবি সফল ও শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে পদত্যাগের হিড়িক নেমেছে। অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক মডেল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা চলছে। এদিকে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস চান শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পেনশন স্কিম 'প্রত্যয়' নিয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি ও শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন- এ দুটো মিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শ্রেণিকক্ষ ছিল খালি। এতে অ্যাকাডেমিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিলেও শ্রেণিকক্ষে ফেরেনি কেউই, নেই কোনো অ্যাকাডেমিক ব্যস্ততা। শিক্ষার্থীদের বিপ্লব পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কী করা উচিত- এসব বিষয়ে ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা হয়েছে ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে।
মোবাইল ফোনে নেয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজগুলো সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে হবে বলে জানান।
গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় এনেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান, শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ক্ষতি পুষিয়ে দিতে 'প্যাটাগজিক্যাল' পরিবর্তন আনা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আলোচনার মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা, রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষার্থী সংসদ ব্যবস্থা চালু করে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা প্রভৃতি।
এছাড়াও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম ফিরিয়ে নিয়ে আসা। আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা বড় অর্জনের পাশাপাশি অনেক 'সেক্রিফাইস'ও করেছে। এতে পড়াশোনায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখন তাদের 'অ্যাকাডেমিক' ক্ষতি পূরণ করে পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে এনে তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার কথাও বলেন তিনি।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, শিক্ষার্থীদের অভূতপূর্ব ও বহু রক্তের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাজের একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যেটাকে যার যার পর্যায় থেকে কাজে লাগানো যায়। এখন অনেকগুলো কাজের ক্ষেত্র বা সুযোগ তৈরি হয়েছে তবে এগুলো সব একসঙ্গে করা যাবে না- অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে করতে হবে।
আরো পড়ুন: জবির ছাত্রকল্যাণ ও পরিবহন পরিচালকসহ আরো দপ্তর প্রধানের পদত্যাগ
প্রথমত, এই আন্দোলনের মূল 'স্পিরিট' ছিলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রাইভেট বা পাবলিক- যে বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক না কেন, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করতে হবে। কারণ, এখানে রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে ন্যায় বিচার ব্যাহত হয়। বর্তমানে আমাদের এ ধরনের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলো মেনে চললেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়। নিয়ম মেনে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার দিকে জোর দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ছাত্রদের উদ্যোগে জাতীয় আন্দোলনটি সংঘটিত হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। ন্যায়বিচার ও একটি যৌক্তিক স্বার্থে শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু, বিশ্ববিদ্যালয় খুলার পরে এটি পুষিয়ে নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছু অতিরিক্ত ক্লাসের মাধ্যমে বা 'প্যাটাগজিক্যাল' কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসা এখন জরুরি। আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা 'সাইকোলজিক্যাল ট্রমা'র মধ্য দিয়ে গেছে এবং তারা পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে ক্যাম্পাস বা শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসবে। সেটার সাইকোলজি বুঝার চেষ্টা করতে হবে। গবেষণা ও পড়াশোনার কিছু 'প্যাটাগজিক্যাল' বিন্যাস করতে হবে। আর এই কাজগুলো বিভাগ, ফ্যাকাল্টি পর্যায়ে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।
অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে 'বৈষম্য' শব্দটার মধ্যেই ন্যায় বিচারের আকুতি রয়েছে। এজন্য যেকোনো সিলেবাসেই ন্যায় বিচারের বিষয়টা 'আন্ডারলাইন ফিলোসফি' হিসেবে দেয়া যেতে পারে। তবে একদিনেই সিলেবাস পরিবর্তন হবে বিষয়টা এমন নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবশ্রেণি পেশার মানুষের কথা বলার সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ, এগুলো মানুষের সম্পদ। কথা বলা বা উচ্ছ্বাস প্রকাশের অধিকার তাদের আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে রাজনীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরে থাকা নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত করার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেমন, শিক্ষার্থী সংসদ। এটি হল ও বিভাগ পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে। এগুলোর চর্চা এতদিন খুব বেশি ছিলো না। এগুলোতে শিক্ষার্থীদের কথা বলা, নেতৃত্ব, সহমর্মিতা, একসঙ্গে চলার চর্চা বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বড় বড় দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করতে হবে বিষয়টা এমনও নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধরনের সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড হবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব গণ্ডির মধ্যেই হবে মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেমিনারকেন্দ্রীক আলোচনা, শিক্ষার্থী সংসদ, কবিতা আবৃত্তি, নিজস্ব ধর্ম পালন প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নেতৃত্বের চর্চা তৈরি হয়। এজন্য বাইরে থেকে রাজনৈতিক দল টেনে এনে নেতৃত্বের চর্চা করার প্রয়োজনীয়তা নাই।
আরো পড়ুন: ট্রেজারারের নেতৃত্বে জবির বেদখল হল উদ্ধার মঙ্গলবার
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করা ও তাদের মনোভাব প্রকাশের সুযোগ দেয়াই প্রকৃত রাজনীতি জানিয়ে তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলে দেখা যায়, সেখানে শিক্ষার্থীদের কোনো কথাও থাকেনা, অপ্রাসঙ্গিক কিছু কেন্দ্রীয় রাজনীতি নিয়ে কথা হয়। এটার তো কোনো মানে হয়না। আমি কথা বলবো আমাদের বিষয় নিয়ে, আমার শিক্ষার্থীরা বাজারে চাকরি পাচ্ছে কিনা, আমরা মনোভাব প্রকাশ করতে পারছি কিনা, লিবারেল আর্টস তো মূল্যবান জিনিস। শুধু চাকরি করা তো ব্যাপার না। এগুলো চর্চা করি, এগুলোই তো রাজনীতি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ভেদাভেদ মানেনি বরং একত্রে কাজ করে তারা তাদের মধ্যকার ঐক্যের প্রদর্শন করেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ আরো বলেন, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা। আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে পাবলিক আর প্রাইভেটের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই দু'ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যে সংগতি তৈরি হয়েছে সেটি বজায় রাখা।
উল্লেখ, ড. নিয়াজ যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মাননাসহ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পাদন করেন। তিনি ১৭০ টির বেশি গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও বইয়ের রচয়িতা।
বর্তমানে ড. নিয়াজ আহমদ খান বর্তমানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক (গ্রেড-১) ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্নেন্স এন্ড ডেভেলপমেন্টের সিনিয়র একাডেমিক এডভাইজর, এবং সেন্টার অফ রিসোর্সেস এন্ড ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক। এছাড়াও তিনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) বাংলাদেশ দপ্তরের প্রধান ছিলেন।
শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউজে 'দক্ষিণ এশিয়া ফেলো', ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের 'রিসার্চ ফেলো', অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটি ইন কায়রোতে 'ডিস্টিংগুইস্ট ভিজিটিং রিসার্চার'; এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যানের ডিস্টিংগুইস্ড ভিজিটিং প্রফেসর'; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের 'অধ্যাপক', এবং থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির 'এশিয়া রিসার্চ ফেলো'র দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আমেরিকান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা, যুক্তরাজ্য সরকারের সোয়ানসি-বে রেশিয়াল ইকুইটি কাউন্সিল এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচিতে উপদেষ্টা ও পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।