×

শিক্ষা

ছাব্বিশের মাধ্যমিক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশা

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:০৮ এএম

ছাব্বিশের মাধ্যমিক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ধোঁয়াশা

ছবি: সংগৃহীত

প্রায় দুই বছর পর ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় সেটি কোন পদ্ধতিতে হবে তার কাঠামো এখনো ঠিক না হওয়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বুঝে ওঠতে পারছেন না কী হতে যাচ্ছে পড়াশোনায়। পরীক্ষা পদ্ধতি ঠিক না হওয়ায় দশম শ্রেণির পাঠ্যবই লেখার কাজও আটকে আছে। অথচ আগামী জানুয়ারি থেকে এই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যবইয়ে পড়াশোনা করবে। সব মিলিয়ে পড়াশোনায় ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রসঙ্গত, পুরনো শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণির একই পাঠ্যবই থাকলেও নতুন শিক্ষাক্রমে এই দুই শ্রেণিতে পৃথক বই করা হয়েছে।

জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ভোরের কাগজকে বলেন, ২০২৬ সালের মাধ্যমিকে মূল্যায়নের কৌশল কী হবে তা নিয়ে জোরেশোরে আলাপ-আলোচনা চলছে। হয়তো খুব তাড়াতাড়ি এর সমাধান হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমটি ভালো হলেও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় ২০২৬ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে তারাই ২০২৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নে লিখিত পরীক্ষা না থাকায় প্রশ্ন এসেছে, ২০২৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে হবে? যদি পরীক্ষা না-ই থাকে তাহলে শিক্ষা বোর্ডগুলোর কী পরিণতি হবে?

কারণ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা নেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো।

এ রকম পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এমনকি গত সপ্তাহের একদিন তিনি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে আধা বেলা অফিসও করেছেন। সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে মন্ত্রী নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন কীভাবে হবে অর্থাৎ লিখিত পরীক্ষাসহ বেশ কিছু বিষয় থাকবে কিনা এ নিয়ে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞদের কাছে তার একটি প্রস্তাবনা চেয়েছেন। আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে (আমাই) সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সেই প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবেন। তারা বলেছেন, যদি হাতে-কলমের পরীক্ষা ফিরে আসে তাহলে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইগুলো ফের বদলে যেতে পারে। তখন পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে অনুশীলনী যুক্ত হতে পারে।

জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে ২০২৬ সালে। পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আমাইতে শিক্ষামন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মূল্যায়নসংক্রান্ত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবেন। তারপর বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। এর পরেই দশম শ্রেণির পাঠ্যবই লেখার কাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নতুন শিক্ষাক্রমটি খুবই ভালো হয়েছে। ঠিকমতো এর বাস্তবায়ন হলে জাতি এর সুফল পাবে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের জন্য ৮টি উপকরণ রাখার সিদ্ধান্ত ছিল। এগুলো হচ্ছে- কুইজ, প্রতিবেদন, উপস্থাপন, প্রশ্নোত্তর, ব্যবহারিক, স্বমূল্যায়ন, সহপাঠী মূল্যায়ন ও প্রতিবেশী মূল্যায়ন। অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর পর্বের নাম দিয়ে লিখিত পরীক্ষাও ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে খুশি রাখতে গিয়ে মূল্যায়নের ৮টি অংশের মধ্যেই মাত্র কুইজ, প্রতিবেদন ও উপস্থাপন রেখে বাকি ৫টিকেই বাদ দিয়ে দেন। এর ফলে মূল্যায়ন থেকে হাতে-কলমের পরীক্ষা বাদ পড়ে।

লিখিত পরীক্ষা বাদ পড়ায় সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়াশীলরা একে ব্যবহার করে বলতে থাকে, পড়ালেখা শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে শুধু ডিম ভাজা কীভাবে করতে হয় তা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু এর প্রতিবাদে শিক্ষক এবং শিক্ষা কর্মকর্তারা অদ্ভুতভাবে নীরব থাকেন। ফলে শিক্ষাক্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন আছে, পাস-ফেল আছে, প্রতিদিনের পাঠদান আছে, পাঠের পূর্বপ্রস্তুতি আছে, আবার শিক্ষককেও ফলাফল দিতে হবে। অর্থাৎ ঠিক নিয়ম মেনে সন্তানকে পড়িয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে অভিভাবকদের। সব মিলিয়ে অভিভাবকরা সন্তানের পড়াশোনা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে পারবেন। এককথায়, শিক্ষাক্রম নিয়ে সবার ইতিবাচক ভূমিকা তৈরি হবে। কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষাক্রমের পর্যালোচনা হওয়া দরকার। কেন এত ভালো শিক্ষাক্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হলো? কোথায় এর গলদ? প্রতিক্রিয়াশীলরা এই শিক্ষাক্রম নিয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ালেও শিক্ষা কর্মকর্তা এবং শিক্ষকরা কেন নীরব থাকছেন? কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা শিক্ষাক্রমের পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারলেন না? সব কিছুর পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করে একটি এনজিও সংস্থা বলেছে, আগের শিক্ষাক্রমগুলোতে লিখিত পরীক্ষা থাকায় শিক্ষার্থীকে পুরো বইটি কয়েক দফা পড়তে হতো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে আজ যে অংশটি পড়বে সেটি আগামীকাল আর পড়া লাগবে না। কারণ অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় লিখিত পরীক্ষা না থাকায় যে দিন যে অংশ পড়বে ওইদিনই তা উপস্থাপন করবে এবং এই উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে পড়া শেষ হয়ে যাবে। সঙ্গত কারণেই মূল্যায়নের কৌশল পরিবর্তন না করলে অর্থাৎ হাতে-কলমে লিখিত পরীক্ষা যুক্ত না করলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে যেভাবে পাঠ্যবই লেখা হয়েছে তাতে হাতে-কলমে পরীক্ষা সংযোজনের উপায় আছে কিনা জানতে চাইলে পাঞ্জেরী প্রকাশনীর প্রধান প্রকাশনা কর্মকর্তা সুনীল কুমার ধর ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমটি অত্যন্ত ভালো এবং যুগোপযোগী। এই শিক্ষাক্রমে যেভাবে পাঠ্যবই লেখা হয়েছে তাতে হাতে-কলমের পরীক্ষা (পেপার-পেন্সিল টেস্ট) অনায়াসে যুক্ত করা যাবে।

তিনি বলেন, নতুন পাঠ্যবইয়ে প্রতিটি শিখন অভিজ্ঞতাতে বিষয়বস্তু আছে। শিখন ফল আছে। পারদর্শিতার সূচকও আছে। এখন এসব বিষয়কে আমলে নিয়ে অনুশীলনী যুক্ত করে দিলেই হবে। সেই অনুশীলনী থেকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশ্ন করা যেতে পারে এবং সেই প্রশ্ন হবে যোগ্যতা ভিত্তিক।

এদিকে, নতুন পাঠ্যবই যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করে শিগগিরই সংশোধন দেয়া হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও গভীর পর্যবেক্ষণে যে সব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলেও বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মো. ফরহাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বছরের প্রথম দিনে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের সময় সব শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে তাদের পরামর্শ জানাতে বলা হয়েছিল। আপনারা আমাদের সে আহ্বানে ইতিবাচক মতামত দিয়েছেন। আপনাদের এ মতামত আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়ে বিদ্যমান পাঠ্যপুস্তক যৌক্তিকভাবে মূল্যায়ন করে সংশোধনীগুলো অতিদ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমে পাঠানো হবে। যারা নানা তথ্য, উপাত্ত, যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং সঠিক উপস্থাপনার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের মানোন্নয়নে সহায়তা করছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছে এনসিটিবি।

জানা গেছে, সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অধ্যায়ে ‘শরীফার গল্প’ নামে একটি গল্প নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া নাগরিকদের নিয়ে রচিত এ গল্পে ‘ট্রান্সজেন্ডার প্রোমোট’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে একটি পক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে ‘শরীফার গল্প’ গভীরভাবে পর্যালোচনা করে এনসিটিবিকে সহায়তা করতে ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রশীদকে এই কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গভর্নর মুফতি মাওলানা কফিল উদ্দীন সরকার, এনসিটিবির সদস্য মশিউজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হালিম এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল নিজেও বলেছেন, পাঠ্যবইয়ে ‘শরীফার গল্প’ উপস্থাপনে কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি থাকলে তা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

তবে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রমকেও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কব্জা করতে চাইছে। তারা বর্তমান শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে আন্দোলনে নেমেছে। এই আন্দোলনে সরকারকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। আর ‘মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির’ দাবি মেনে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন না করার আহ্বান জানিয়েছেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এদিকে নবম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের গাজার অবস্থানকে গাম্বিয়া হিসেবে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া একই শ্রেণির কিছু বই লেখা হয়েছে ব্লগ, বিদেশি কোচিং সেন্টার এবং ওয়েবসাইট থেকে কপি করে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App