×

শিক্ষা

কলেজ সরকারি হলেও কপাল ফেরেনি তাদের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:২১ এএম

কলেজ সরকারি হলেও কপাল ফেরেনি তাদের

ফাইল ছবি

** শিক্ষকদের বেতন কমছে প্রায় ১১ হাজার টাকা ** বেশি ফি দিয়ে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ** সুবিধা না পেয়েই অবসরে বহু শিক্ষক-কর্মচারী

‘সম্মানের অভাব, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পদমর্যাদায় অবনতি’- এই তিন মিলিয়ে হতাশায় দিন কাটছে নতুন জাতীয়করণকৃত ৩০৪ কলেজের সাড়ে ১৯ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর। এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষক ও সাড়ে ৫ হাজার কর্মচারী রয়েছেন। এসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অনেকে সরকারি সুযোগ সুবিধা না পেয়েই অবসরে যাচ্ছেন। আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮ এর অসঙ্গতির জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও কমে যাচ্ছে। গত সাত বছর ধরে এই অবস্থা চললেও কবে নাগাদ তাদের হতাশার অবসান হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নতুন সরকারি হওয়া কলেজে শুধু শিক্ষক-কর্মচারী নয়, শিক্ষার্থীরাও সমস্যায় পড়েছেন। কলেজ সরকারি হলেও শিক্ষার্থীরা সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যেসব কলেজের আত্তীকৃত শিক্ষকরা যোগদান করেছেন শুধু সেসব কলেজের শিক্ষার্থীরা সরকারি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, আর বাকি কলেজের শিক্ষার্থীদের বেসরকারি আমলে ধার্যকৃত বেশি টাকা ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় শিক্ষার্থীরাও জানেন না।

নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কলেজগুলো সরকারি হওয়ার পর শিক্ষকদের বেতনসহ মর্যাদা বাড়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। বেসরকারি অবস্থায় কলেজে যারা সহকারী অধ্যাপক ছিলেন, কিংবা সিনিয়র প্রভাষক ছিলেন তারা ষষ্ঠ গ্রেডে বেতন পেতেন।

কিন্তু সরকারি হওয়ার পর তাদের চাকরি আত্তীকরণ হলে দেখা যায়, তারা সবাই চলে গেছেন চাকরিজীবনের শুরুতে, অর্থাৎ প্রারম্ভিক ধাপে। যেখানে বেতন হয় নবম গ্রেডে। পরিস্থিতি তাদের শুধু এখানেই আটকে রাখেনি, নতুন সরকারি কলেজে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ন্যায্যতা নিশ্চিতসহ পদোন্নতি নীতিমালা প্রণয়ন না হলে তারা চাকরিজীবনে পদোন্নতিই পাবেন না। নবম গ্রেডে থেকেই তাদের অবসরে চলে যেতে হবে। এমন ধারা শুধু শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা নয়- লাইব্রেরিয়ানদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। বেসরকারি থাকাবস্থায় কলেজগুলোতে লাইব্রেরিয়ানরা সপ্তম গ্রেডে বেতন পেতেন। কিন্তু সরকারি হওয়ার পর তারা এখন বেতন পাবেন দশম গ্রেডে। এর ফলে তাদের বেতন কমেছে প্রায় ১৮ হাজার টাকা।

এসব কারণে নতুন সরকারি হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষকরা মনে করছেন, তাদের সর্বনাশ হয়েছে। কলেজ সরকারি হওয়া নিয়ে শুরুতে তাদের মধ্যে যতটুকু আনন্দ ছিল এখন তা ততটুকুই হতাশায় রূপ নিয়েছে। তারা বলেছেন, তাদের পদের গরিমা কমেছে, তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এলাকায় তাদের সম্মান বলতে আর কিছুই নেই। তারা নীরবে চোখের জল ফেলছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব সরকারি হওয়া কলেজগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের ‘বোবাকান্না’র কথা স্বীকার করে ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারি হওয়ার পর শিক্ষকদের বেতন কমেছে এবং বর্তমান বিধান অনুযায়ী তাদের পদোন্নতিও হবে না। শিক্ষকরা এ নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এসব কলেজে কর্মরতদের জন্য ন্যায্যতা প্রাপ্তিসহ পদোন্নতি নীতিমালার খসড়া প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজগুলো শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

জানতে চাইলে নতুন সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারিকরণের ভেল্কি থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ আমাদের জানা নেই। দিন যত যাচ্ছে, আইনের নতুন নতুন ধারা সামনে আসছে। এ এক অসহনীয় জীবন।

তিনি বলেন, নানা বৈষম্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ বিধি সংশোধনের জন্য সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি (সকশিস) যথাযথ কর্তৃপক্ষ বরাবর বারবার আবেদন ও যোগাযোগ করলেও অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে আলোর মুখ দেখছে না। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ নিষেধাজ্ঞা থাকায় সরকারিকৃত কলেজগুলোতে প্রায় ২১২টি অধ্যক্ষ ও ১৯৩টি উপাধ্যক্ষ এবং অনেক বিষয়েই শিক্ষক পদ শূন্য হয়েছে। অনেক কলেজে করণিক পদ শূন্য এবং সহায়ক কর্মচারীও কমে গেছে। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিস্থিতি ও অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখার কোনো উদ্যোগ চোখে না পড়লেও বিসিএস ক্যাডার থেকে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে সংযুক্ত হয়ে পদ দখলের সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। সব যেন ডিপ ফ্রিজে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, ৩০৪টি কলেজের মধ্যে ১৩৩টি কলেজের প্রশাসনিক কাজ শেষ করে এনেছে সরকার। এর মধ্যে ৬৩ কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারি সুবিধা পাওয়া শুরু করেছেন। বাকি ১৭১টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণসহ নানা বিষয় নিষ্পত্তির জন্য নথিগুলো সচিব কমিটিতে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কাছে জানতে চেয়েছে, নতুন সরকারি হওয়া কলেজে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের কেন আত্তীকরণ করতে হবে? ১৩৩টি কলেজের কাজ শেষ করার পর এসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এমন তথ্য জানতে চাওয়ায় সংশ্লিষ্ট মহলে ‘বিভাজন’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তাদের মতে, ১৩৩টি কলেজের কাজ শেষ করে বাকি ১৭১টি কলেজের ক্ষেত্রে এসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কেন এই তথ্য জানতে চাইল? ১৩৩টি কলেজের বেলায় এমন তথ্য কেন জানতে চাইল না? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ শুরুতেই এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাইলে আজকে বিভাজনের বিষয়ে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু তা না করে এখন এসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই চিঠি নতুন সরকারি হওয়া কলেজগুলোতে অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলেছে।

১৩৩টি কলেজের কাজ শেষ করার পর বাকি কলেজের কাজের আগে মন্ত্রিপরিষদ এমন তথ্য কেন জানতে চাইল- প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কোনো কলেজে অনার্স কোর্স চালু করতে হলে বিষয়ওয়ারি শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। জাতীয়করণ হওয়া বেশির ভাগ কলেজে এভাবে অনার্স কোর্সের জন্য দেদারছে শিক্ষক নিয়োগও হয়েছে।

নিয়োগ হওয়া শিক্ষকরা যোগদানের সময় নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে বলেন, তারা জীবনে কোনোদিন এমপিওভুক্তির দাবি করবেন না। এভাবেই তাদের জীবনের ধারাপাত চলছিল। কিন্তু যেই কলেজ সরকারি হয়ে গেল, তাদেরও কপাল খুলে গেল। অর্থাৎ যারা স্ট্যাম্পে সই দিয়ে এমপিওভুক্তির দাবি করবেন না শর্তে কলেজে শিক্ষক পদে যোগ দিয়েছিলেন তারাই সরকারি শিক্ষক হয়ে যাচ্ছেন। ঠিক ওই জায়গাতেই সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নজর দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চেয়েছে, এমপিওভুক্তি দাবি না করা শিক্ষকরা কীভাবে আত্তীকৃত হবেন?

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে বলা হয়েছে, ১৩৩টি কলেজে যেভাবে শিক্ষক-কর্মচারীদের আত্তীকরণ হয়েছে ঠিক সেভাবেই যেন বাকি কলেজগুলোর কাজও শেষ হয়। এখানে বিভাজনের নীতি টানা ঠিক হবে না। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে নীরবতা পালন করছে। এদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা এখনো জানানো হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে দেশের যেসব উপজেলায় একটিও সরকারি কলেজ নেই সেসব উপজেলায় একটি করে কলেজকে সরকারি ঘোষণা করেন। এরপর দীর্ঘ সাত বছর পার হলেও সরকারি হওয়া কলেজগুলো সুবিধা পাবে দূরে থাক, নতুন নতুন সমস্যার জেরবার হয়ে পড়েছে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের নির্দেশনায় তৎকালীন শিক্ষা সচিব সরকারিকরণের কাজের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০টি কমিটি করে দেন।

এসব কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই কাজ শেষ করার পর দেখা যায়, বৈষম্যের শিকার হন শিক্ষক-কর্মচারীরা। আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) নেতারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে দেখা করার পর আবার কাজ শুরু হয়। ১৩৩টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের পদ সৃজনের অনুমোদনের পর শুরু হয় সময়ক্ষেপণের নতুন কৌশল।

সমিতির নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে আয়োজিত প্রথম প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির সভার প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পদসংখ্যা ৪০টির বেশি হলেই ‘অধিকতর যাচাই’ নতুন শব্দ সংযোজন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফাইল ফেরত পাঠাতে শুরু করেন। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) নেতারা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এরপর আবার কাজ শুরু হলেও এমপিও, নন-এমপিও বিভাজনের নীতি সামনে নিয়ে আসা হয়। পাশাপাশি দেখা যায়, নিয়োগ ও বেতন-ভাতাদি উত্তোলনকারীদের মধ্যে বেসরকারি আমলে টাইম স্কেল প্রাপ্য ৭ম গ্রেডে কর্মরত প্রভাষকদেরকে ৯ম গ্রেডে, টাইম স্কেল প্রাপ্য ৯ম গ্রেডে কর্মরত প্রর্দশক ও শরীরচর্চা শিক্ষকদেরকে ১০ম গ্রেডে, টাইম স্কেল প্রাপ্য ৭ম গ্রেডে কর্মরত লাইব্রেরিয়ানদেরকে ১০ম গ্রেডে, ১০ম গ্রেডে কর্মরত সহকারী লাইব্রেরিয়ানদেরকে ১৩তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ করায় এসব পদে কর্মরতদের বেতন কমে গেছে।

বেতন কমার বিষয়ে সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতি (সকশিস) শিক্ষা সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করার পর বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত জানতে চায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টির ওপর মতামত জানতে চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) চিঠি দেয়। মাউশি বেসরকারি আমলে প্রাপ্য গ্রেড বহাল রাখার পক্ষে মতামত দিয়ে জবাব দাখিল করে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও একই সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এগুলো ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে। এদিকে যেসব কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নিয়োগও শেষ হয়নি। এদের মধ্যে অনেকে বাদ পড়ছেন। বাদ পড়াদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় আটকে দেয়া হয়েছে। এদের কারো ফাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারো ফাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আপত্তি দিয়েছে। আপত্তি দিলেও নিষ্পত্তির জন্য কোনো প্রকার উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এমন পরিস্থিতিতে আপত্তি পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীরা তদবির বাণিজ্যের স্বীকারে পরিণত হচ্ছেন। তদবির করলে ফাইল নড়ে, আর না করলে ডিপ ফ্রিজে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নতুন সরকারি হওয়া কলেজগুলোর পাঠদান ও ব্যবস্থাপনা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App