×

শিক্ষা

নতুন পাঠ্যবই নিয়ে উৎকণ্ঠায় শিক্ষা প্রশাসন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২২, ০৯:০৭ এএম

নতুন পাঠ্যবই নিয়ে উৎকণ্ঠায় শিক্ষা প্রশাসন

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)

ইসলাম শিক্ষা, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে চলছে পরিবর্তনের কাজ

মন্ত্রিসভায় সিনিয়র সদস্য ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের আপত্তি, আওয়ামী লীগের একটি অংশের ঘোর বিরোধিতা, নির্বাচনের বছরে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই নিয়ে জনঅসন্তোষের আশঙ্কায় আগামী শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠায় শিক্ষা প্রশাসন। বিশেষ করে মাদ্রাসা শিক্ষকদের আপত্তির মুখে উৎকণ্ঠা কাটাতে ছাপা বাদ দিয়ে দুই শ্রেণির ২০টি বইয়ের কিছু কিছু অংশ আবার ঠিকঠাক করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি। বইগুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল টেকনোলজি, জীবন ও জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিল্প সংস্কৃতি ও ধর্ম। তবে এ দুই শ্রেণির ইসলাম শিক্ষা এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে অন্তত ১০টি পৃষ্ঠার টেক্সট পরিবর্তনের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে বই ছাপিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হবে। এই জটিলতার ফলে আগামী শিক্ষাবর্ষে ১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা হাতে বই পাচ্ছে না। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাপাখানায় যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে বইগুলো দেখতে গত মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার পাঠ্যবই নিয়ে দু’দফায় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী। এ সময় পাঠ্যবইয়ের নানা ত্রæটি তাদের চোখে ধরা পড়ে। এতে কোনো বইয়ে ছবি বেশি হয়েছে, আবার কোনো বইয়ের ‘কনটেন্ট’ কম হয়েছে। কোথাও আবার ইতিহাসের বর্ণনা কম হয়েছে। কোনো বইয়ে মাদ্রাসার উপযোগী কোনো ছবি সংযুক্ত হয়নি। তখনই মন্ত্রী এসব বিষয় পরিবর্তনের নির্দেশ দেন। ইসলাম শিক্ষা বইয়ে ‘কাফের’ সংক্রান্ত রচনাটি পরিবর্তনের নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ইতিহাস অংশে আরো তথ্য সংযুক্তির নির্দেশ দেন।

জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, বইয়ের যেসব জায়গায় ত্রুটি ছিল তা নিরসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষকদের আপত্তির ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, তারা সব সময়ই আপত্তি তুলে। তবু তাদের যতটুকু দাবি যৌক্তিক মনে হয়েছে সেগুলো পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচনের বছরে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিরোধীরা রাজনীতির মাঠ গরম করতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঠ গরমের কোনো যৌক্তিক কারণ আছে বলে আমি মনে করি না। এখন যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে পাঠ্যবই নিয়ে মাঠ গরম করতে চায় তাহলে বুঝতে হবে তাদের উদ্দেশ্য দূরভিসন্ধিমূলক।

এদিকে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন নিয়ে এনসিটিবিতে দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে। একপক্ষ বলছে, আগামী বছর নির্বাচনের বছর। পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করেই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে নির্বাচনে বছর নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। এতে নানাপক্ষ রুষ্ট হয়ে মাঠ গরম করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। এ কারণে ২০২৩ সালে আরো বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করে পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল থেকে নতুন বইয়ে পড়াশোনা শুরু করার কথা বলেছে। অপর পক্ষ বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এরই মধ্যে যারা আপত্তি তুলেছেন তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেয়া হয়েছে। এর ফলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে কোনো মাঠ গরম হবে না। তবে এই দুই পক্ষের মতবাদের মধ্যেই একটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন না করতে উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করেন। শুনানি শেষে সেটি রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশনা মেনে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই রচনার কাজ শেষ হয়েছে। এখন কিছু অংশ ঠিকঠাক করা হচ্ছে। এরপরেই বইগুলো ছাপাতে দেয়া হবে। তিনি বলেন, ২০২৩ সালে অর্থাৎ আগামী বছর এই দুই শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে পরীক্ষামূলক সংস্করণের পাঠ্যবই তুলে দেয়া হবে। এরপরে অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে বইগুলো পরিমার্জন করা হবে। এক্ষেত্রে যদি পুনর্লিখনের দরকার হয় তাও করা হবে।

এনসিটিবি সূত্র জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী এনসিটিবির কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেই বৈঠকেই মন্ত্রী মাদ্রাসা শিক্ষকদের দেয়া আপত্তির তালিকা নিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই পর্যালোচনা করেন। এতে কিছু কিছু জায়গায় তাদের দাবিকে যৌক্তিক হিসেবে অ্যাখায়িত করেন। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বই দেখে মন্ত্রী বলেন, এই বইয়ে ইতিহাসের বর্ণনা কোথাও কোথাও কম হয়েছে। এগুলো সংযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নতুন বই নিয়ে কী কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তাও আলোচনা হয়। মঙ্গলবার এনসিটিবিতে দীর্ঘসময় বৈঠক করার পরও পুরো বিষয়ের পর্যালোচনা শেষ না হওয়ায় গতকাল বুধবার সকালে মন্ত্রী মন্ত্রণালয়ে নিজ দপ্তরে ফের বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকেই ইসলাম শিক্ষা বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলাম শিক্ষা বিভাগের কোনো অধ্যাপককে দিয়ে দেখিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপক বইটি দেখবেন তা জানা যায়নি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রিসভার কয়েকজন সিনিয়র সদস্য চাইছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমটি কেবিনেটে উত্থাপনের জন্য। কিন্তু শিক্ষাক্রমের বিষয়টি কখনোই কেবিনেটে উত্থাপিত হয়নি জানালে মন্ত্রীরা বলেন, নির্বাচনের বছরে কেন নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে? আগে কেন করা হল না। ঠিক এই বিষয়টিই এনসিটিবিতে আলোচনায় এসেছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, এনসিটিবির কর্মকর্তারা নতুন শিক্ষাক্রমের আদ্যপান্ত খুব একটা না পড়লেও এটি নিয়ে জানুয়ারিতেই মাঠ গরম হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন। এ কারণে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পড়াশুনা একবছর পিছিয়ে দিতে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষা প্রশাসন উদ্বিগ্ন কথাটি বলা ঠিক নয়। তবে শিক্ষামন্ত্রী শেষ মুহূর্তে বইগুলো দেখে কিছু সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েছেন। এর মধ্যে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে বাড়তি কিছু ছবি ছিল, এগুলো সরানোর কথা বলেছেন। ইতিহাস অংশে সাত/আট পৃষ্ঠার মতো কিছু লেখা যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলাম শিক্ষা বইয়ে মাদ্রাসা উপযোগী টুপি মাথায় দেয়া ও হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের ছবি যুক্ত হবে। পাশাপাশি এই বইয়ের একজায়গায় ‘কাফের’ নিয়ে লেখা রচনাটি সরিয়ে দিতে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। পাশাপাশি ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে এমন লেখাও সরাতে বলেছেন মন্ত্রী। এমনকি সম্প্রীতির বার্তা দেয় হাদীসের এমন বাণী পাঠ্যবইয়ে সংযোজনের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিটিবির মাধ্যমিক শিক্ষা শাখার একজন বিশেষজ্ঞ ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব মহল থেকে প্রতিক্রিয়া আসবে। কারণ দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে তার পুরোটাই একসঙ্গে বদলে ফেলতে চাচ্ছে তারা। তারমতে, শিক্ষায় সংস্কার আনতে হয় ধীরে ধীরে। কিন্তু একসঙ্গে পাল্টাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে। এ কারণে ছাপা বাদ দিয়ে এখন নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই ঠিকঠাক করতে হচ্ছে।

এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থা মৌলবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে অভিযোগ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকার ভার্সেটাইল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মো. আলমগীর। গতকাল তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, রিটের শুনানি শেষ হয়েছে। রায়ের অপেক্ষায় আছে। প্রয়োজনে তিনি এটা নিয়ে আপিল আদালতেও যাবেন বলে জানান। রিটকারীর আইনজীবি এডভোকেট জে কে পাল (ঝুলনকান্তি পাল) ভোরের কাগজকে বলেন, আদালত প্রথমবার রিটটি শুনতে চাননি। পরে আরেকটি আদালতে রিট শুনানি শেষে রায়ের অপেক্ষায় আছে। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম পড়াশোনা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে রিটে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মতে, অনেক অভিভাবকই এদেশের মৌলবাদি শিক্ষা ব্যবস্থায় তার সন্তানকে পড়াতে চাইবেন না। এরফলে শিক্ষায় বিদেশগামীর সংখ্যা বাড়বে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App