×

অর্থনীতি

বাড়বে তারল্য সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৯, ১১:৪৭ এএম

বাড়বে তারল্য সংকট
দেশের ব্যাংক খাতে বিরাজ করছে তারল্য সংকট। এরই মধ্যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বড় অঙ্কের টাকা ধার করতে যাচ্ছে সরকার। এতে সংকট আরো প্রকট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন না। এদিকে চলতি অর্থবছরের শেষ মুহূর্তে এসে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৮ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। দেখা গেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড় উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই ঋণ পরিশোধ করছেন না। নানা কৌশল অবলম্বন করে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের আমানত ফেরত দিচ্ছেন না বড় উদ্যোক্তারা। উপরন্তু তারা প্রতিনিয়তই ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকে কমে গেছে নগদ আদায়। নগদ আদায় কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। বাড়ছে মূলধন ঘাটতিও। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল কমে যাচ্ছে। তুলনামূলক কম সুদ হওয়ায় ব্যাংকে আমানত প্রবাহ কমে গেছে। এতে দেখা দিয়েছে চরম তহবিল সংকট। সব মিলে সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে আদায় বাড়াতে না পারলে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে এ খাতকে। এমন প্রেক্ষাপটে রুগ্্ণ ব্যাংক খাতের দিকেই হাত বাড়িয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ঘাটতি বাজেট দিয়েছেন। এই ঘাটতি দুটি উৎস থেকে মেটাতে হবে তাকে। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎস, আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বৈদেশিক উৎস। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেবেন ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা; জিডিপির ১ দশমিক ৬ শতাংশ- যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। এতে সংকট আরো প্রকট হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকগুলোতে যখন তারল্য সংকট, সেই সময় সরকারের এত বেশি ঋণ নেয়া ঠিক হবে না। কেন না সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নিলে ব্যক্তি শ্রেণির উদ্যোক্তারা- যারা ব্যাংকনির্ভর, তারা খুব অসুবিধায় পড়বেন। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারো কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। অন্যদিকে কোনো কোনো ব্যাংক রয়েছে গভীর তারল্য সংকটে। টাকা না থাকায় অনেক ব্যাংক ব্যবসা করতে পারছে না। তারল্য সংকট থেকে ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর মুনাফা কমে গেছে অর্ধেক। খোদ অর্থমন্ত্রীও ব্যাংকিং খাত নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ বাজেট বক্তৃতায় তিনি ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ৬ দফা প্রস্তাবও তুলে ধরেন। মানুষ ব্যাংকে আমানত রাখতে ভয় পাচ্ছে। ব্যাংক খাতে আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ছে। এতে তারল্যের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। চাপ সামলাতে অন্য ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করতে হচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংককে। তারল্যের ওপর চাপের কারণে সুদহার বাড়তির দিকে রয়েছে। ২০১৭ সালের শেষ প্রান্তিকে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করায় নগদ টাকার সংকটে পড়তে হয় দেশের অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংককে। এর ঢেউ এসে আঘাত করে পরের অর্থবছরে। বর্তমানে নিজ প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থও নেই অনেক ব্যাংকের। টাকা ধার নেয়ার এ তালিকায় আছে এবি ব্যাংক, ন্যাশনাল, অগ্রণী, সিটি, ওয়ান, ইউনিয়ন, এনসিসি, প্রিমিয়ার, প্রাইম, স্ট্যান্ডার্ড, এনআরবি ও উত্তরা ব্যাংক। জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবুল কাশেম খান বলেন, ব্যাংকগুলোতে চলছে তারল্য সংকট। বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রায় সব ব্যাংকই। আমরা বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোর দ্বারস্থ হলেও তহবিল পাচ্ছি না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচ্চমাত্রায় ব্যাংকঋণের প্রাক্কলন বেসরকারি খাতে ঋণের জোগানকে টেনে ধরবে। এদিকে গত অর্থবছর শেষে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণস্থিতি ছিল ৮৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ২৯ মে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ৮৯৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকায়। ফলে চলতি অর্থবছরের ওই দিন পর্যন্ত সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে ৯ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৯ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণস্থিতির মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকে রয়েছে ৭৩ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩৩ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়। ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ঋণ নেয়, যা স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে বিবেচিত। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে সুদ হার রয়েছে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশের মতো। আর বন্ডের মাধ্যমে সরকার ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি ঋণ নেয়। বর্তমানে সরকারকে এসব ব্যাংকের সুদ হার বাবদ ৬ দশমিক ৩২ থেকে ৮ শতাংশ ব্যয় করতে হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থবছরের শেষ সময়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধি এবং রাজস্ব আদায় আশানুরূপ না হওয়ায় সরকারের ঋণ বেড়েছে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এমনিতেই নগদ টাকার সংকট, এর ওপর সরকারের ঋণ নেয়ার হার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ আরো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানের ওপর।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App