×

অর্থনীতি

ডিজিটাল প্রতারণা রুখবে কে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:১২ এএম

ডিজিটাল প্রতারণা রুখবে কে

প্রতীকী ছবি

প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে সটকে পড়ছে অ্যাপসভিত্তিক কোম্পানি

দেশ দ্রুতগতিতে ডিজিটাল হয়ে উঠছে। লেনদেনব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে। এসেছে ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতি। এতে ঘরে বসেই লেনদেন করা যাচ্ছে নিমিষে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণাও। সম্প্রতি দুবাইভিত্তিক এমএলএম প্রতিষ্ঠান অ্যাপ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ বা এমটিএফই সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে। প্রতারণার ফাঁদে ফেলে লক্ষাধিক মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এজন্য বর্তমানে অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি ও আগাম আর্থিক অপরাধ শনাক্তে দেশে মজবুত ভিত্তি গড়ে না ওঠাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এসব প্রতারণা রুখতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেয়াকেও দায়ী করছেন কেউ কেউ। অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে- এসব প্রতারণা রুখবে কে? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, মাইক্রোক্রেডিটভিত্তিক প্রতারণা দেখার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি নয়।

দেশের খুব কম মানুষই আছেন যারা ভোলেননি ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের কথা। ডেসটিনির আদলে পরবর্তী সময়ে যুবক, ইউনিপেটুইউসহ একের পর এক এমএলএম কোম্পানি গড়ে ওঠে দেশে। এর মধ্যে ২০০৬ সালে যুবক ২ হাজার ৬০০ কোটি, ২০১১ সালে ইউনিপেটুইউ ৬ হাজার কোটি আত্মসাৎ করে উধাও হয়ে যায়। তবুও থেমে থাকেনি এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণা। বতমানে নতুন কৌশলে ভার্চুয়াল পঞ্জি স্কিম বা এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণা চলছে। সবশেষ অ্যাপভিত্তিক এমএলএম স্কিম এমটিএফইর ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ। দেশ থেকেই কয়েক হাজার কোটি টাকা চলে গেছে এই অ্যাপের মাধ্যমে। খুব সহজে ধনী হওয়ার পথ খুঁজতেই এসব অ্যাপে অর্থ বিনিয়োগ করছেন মানুষ। এছাড়া হালের আলোচিত ই-কমার্স ইভ্যালি, ধামাকা, রিং আইডি, ই-অরেঞ্জ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, নিরাপদডটকমসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে গ্রাহকদের অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ উঠেছে অর্থপাচারেরও। শুধু ই-কমার্স খাতের কয়েকটি কোম্পানি গ্রাহকের সামান্য কিছু অর্থ ফেরত দিলেও বাকি টাকার হদিস নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. মেহ্জাবীন হক ভোরের কাগজকে বলেন, মানুষ বারবার প্রতারিত হচ্ছে। তারপরও আবার অনলাইন ট্রেডিংয়ে ঝুঁকে পড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় বিষয় কাজ করে- খুব অল্প সময়ে দ্রুত বড়লোক হওয়ার আকাক্সক্ষা। তিনি বলেন, এ শর্টকাট বিষয়টি স্বচ্ছল এবং অস্বচ্ছল মানুষ- উভয়ের ক্ষেত্রেই কাজ করে। এটাকে লোভ বলা যাবে না; পরিশ্রম না করেই শর্টকাটে কোনোকিছু পাওয়ার আকাক্সক্ষা বলা যায়। ড. মেহ্জাবিন বলেন, আমরা একটি অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফিতির পারদ প্রতিনিয়ত উপরের দিকে উঠছে। এছাড়া বর্তমানে অনলাইনের যুগে একজন আরেকজনের সঙ্গে সহজে ‘কম্পেয়ার’ করতে পারছে। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে মনে করছে- ‘আমাকে কিছু করতে হবে’। ফলে শর্টকাটের দিকে ঝুঁকছে। তিনি আরো বলেন, এর সঙ্গে আরো একটি কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা। সঠিক জায়গায় খোঁজখবর না নিয়েই বিনিয়োগ করার কারণে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি কাজ করছে। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, আমি মনে করি একজন ব্যক্তিকেই আগে তার নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এরপর সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার জায়গা আসে। তিনি আরো বলেন, যারা এসব ব্যবসার মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতে তারা সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো বুঝতে পারে। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষ জীবন ধারণে হিমশিম খাচ্ছে। সুতরাং এই সময়ে কীভাবে পরিশ্রম ছাড়া শর্টকাটে অর্থ উপার্জন করা যাবে- মানুষ সেই চিন্তায় থাকে। তখন খুব সহজেই তারা এসব ফাঁদে পা দেয়।

এদিকে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অনলাইন ট্রেডিংয়ে ঝুঁকে পড়ার পেছনে অতিলোভের পাশাপাশি বেকারত্বও অনেকাংশে দায়ী। তিনি বলেন, অনেক শিক্ষিত বেকার কোনো চাকরি পাচ্ছে না। বেকার বসে আছে, পরিবারের বোঝা হয়ে আছে। শেষ পর্যন্ত অনেকে ধারদেনা করে হলেও এ পথে নামছে। অনলাইনে ব্যবসা করতে এসে আরো নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। ড. মনসুর বলেন, কাজেই দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিকল্প নেই। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান করা গেলে এ ঝুঁকির পথে পা বাড়াবে না।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে শুরু হয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে এমএলএম ব্যবসা। ই-ভ্যালি শুরুতে যখন ব্যবসায় নেমেছিল তখন তাদের ১০০ শতাংশ ক্যাশব্যাক, ১৫০শতাংশ ক্যাশব্যাক অফারের কথা অনেকেরই মনে আছে। যা রাতারাতি প্রতিষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। একপর্যায়ে ই-ভ্যালির নিবন্ধিত গ্রাহক ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ই-ভ্যালির পথ ধরে ব্যবসা শুরু করে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, এসপিসি ওয়ার্ল্ড, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, আলাদিনের প্রদীপ, এসকে ট্রেডার্স, প্রিয়শপ, ২৪টিকেট ডট কম, গ্রিনবাংলা, এক্সিলেন্টবিগবাজার, ফাল্গুনিশপসহ প্রায় ২৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। গ্রাহকদের অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এগুলোর মালিকপক্ষের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলমান। কিছু ই-কমার্স গ্রাহক টাকা ফেরত পেয়েছেন, তবে বেশির ভাগই প্রতারিত হয়ে পথে পথে ঘুরছেন।

সবশেষ চলতি সপ্তাহে ‘মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ’ বা এমটিএফই নামের একটি এমএলএম স্কিমের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ। মূলত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের প্রবাসীদের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসাটি ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের লোকজনকে বলা হয়েছে, এটা ইসলামী শরিয়তসম্মত একটা ব্যবসা। এই টাকা বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে। সেখান থেকেই সদস্যদের মুনাফা দেয়া হবে। এই অফারে অনেকেই জমি বিক্রি কিংবা ঋণ করে এমটিএফইতে বিনিয়োগ শুরু করে। এখানে ট্রেডিংয়ে কারেন্সি হিসাবে ব্যবহার হতো ডলার। এ ডলার কিনতে হতো বাংলাদেশি মুদ্রায়। পরবর্তীকালে ডলার রূপান্তর হতো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রায়। বাংলাদেশে যা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কিন্তু কোম্পানি তাদের বোঝাত ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই’ প্রযুক্তির মাধ্যমে রোবোটিক লেনদেন করত এমটিএফই। অর্থাৎ রোবট নিজেই প্রতিদিন লেনদেন করত আর তাদের লাভ এনে দিত। নিজের জমি বিক্রি করে এ অ্যাপে বিনিয়োগ করেছিলেন আরিফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমি প্রথমে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে এই কোম্পানি সম্পর্কে জানতে পারি। আমাকে বলা হয়, বিদেশি একটা কোম্পানিতে ডলারে বিনিয়োগ করা হলে সেখানে যে মুনাফা হবে, সেটা প্রতিদিন আমাদের হিসাবে যোগ হবে। কারো রেফারেন্সে নতুন বিনিয়োগকারী এলে প্রত্যেক নতুন সদস্যের জন্য তিনি দুই ডলার করে পাবেন। যেমন, ১২ জন আমার রেফারেন্সে এসেছিল, তাদের জন্য আমি প্রতিদিন ২৪ ডলার করে পেয়েছি। নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষকে এভাবে সদস্য বানাতে পারলে তাদের সিইও হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হতো। কিন্তু গত ১৮ আগস্টের পর থেকে এমটিএফইর সিস্টেম কাজ করছিল না। একপর্যায়ে সবার ওয়ালেটে মাইনাস দেখাতে শুরু করে। অর্থাৎ গ্রাহকদের কাছ থেকে উল্টো টাকা পাবে বলে দাবি করে এমটিএফই। শুধু দেশে নয়, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা রেমিট্যান্সের অর্থ মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জে (এমটিএফই) বিনিয়োগ করেও প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। বিশেষ করে দুবাই, কাতার, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হয়েছে।

এমটিএফইর মাধ্যমে এ পর্যন্ত কত টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে তা না জানা গেলেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার মতো পাচার হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বা সাইবার পুলিশ এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র, উপপুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেছেন, যে কোনো ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে। তিনি বলেন, প্রতারকচক্র সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে যেসব ফাঁদ পাতে মানুষ অধিক মুনাফার লোভে সেই ফাঁদে পা দেয়। প্রতারিত হওয়ার পর তারা তা বুঝতে পারে। অনলাইনভিত্তিক প্রতারকচক্র চিহ্নিত করে ধরতে পুলিশ এবং একাধিক সংস্থা কাজ করছে বলেও জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা। তবে সবার আগে জনগণকে সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, এ ধরনের অ্যাপসের বিরুদ্ধে এর আগেও অনেকবার আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। এসব অ্যাপস বা সাইট বন্ধ করার জন্য আমরা অনেকবার বিটিআরসিকে বলেছি। এমটিএফই-এর বিষয়ে আমাদের নজরদারি চলছে। বাংলাদেশে এদের যারা রিপ্রেজেন্টটিভ বা মার্কেটিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব। এছাড়া কেউ যদি অভিযোগ দেন, সে অভিযোগও গ্রহণ করে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, আমরা বহুবার, প্রায় প্রতি বছর মানুষদের সতর্ক করে আসছি যেন তারা এ ধরনের অতি মুনাফা কোনো ব্যবসায় বিনিয়োগ না করেন। বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রায় বিনিয়োগ নিয়ে তো আইন-ই আছে। তারপরও মানুষ যদি গোপনে এভাবে ব্যবসায় বিনিয়োগ করছে। এখন তারা ক্ষতির শিকার হয়েছে বলে কথা বলছে, কিন্তু এতদিন তো তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা কারো কাছে কোনো কথাও বলেনি। মানুষ যদি গোপনে গোপনে এরকম কর্মকাণ্ড করে, আমাদের পক্ষে তো তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

বারবার প্রতারিত হওয়ার পরও কেন এ অনলাইন ট্রেডিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ? এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার ও সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, অতিলোভ ও হঠাৎ করে বড় লোক হওয়ার মনোভাবেই ঠকার পরও আবার আসছে এ লাইনে। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে বারবার প্রতারিত হবে- এটাই স্বাভাবিক।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহীন মোল্লাহ বলেন, শর্টকাট বড় লোক হওয়ার লোভেই মানুষ এর প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। তাছাড়া সমাজে এখন শিক্ষিত ও ভালো মানুষের কোনো কদর নেই, সম্মান নেই। যার টাকা বেশি, যে বেশি সম্পদশালী তারই সম্মান বেশি। যদিও সে লোক মূর্খও হয়- তা-ও টাকার কারণে সবাই তাকে সম্মান দেয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App